জ্ঞানদারা ফিরে এসেও দেখলেন জ্যোতি মুখ নিচু করে নিঝুম বসে আছেন। রবি ও জ্ঞানদা তার দুপাশে এসে বসেন।
ঈষৎ উদবিগ্ন জ্ঞানদা জ্যোতিকে আদর করে কাঁধে হাত রেখে জানতে চান, কী হয়েছে নতুনঠাকুরপো, মন খারাপ? আমাদের সঙ্গে এলে না কেন?
জ্যোতি চুপচাপ মেজোবউঠানের কাঁধের ওপর মাথা রাখেন। সমুদ্রের ঢেউ যেরকম বাংলোর সিঁড়িতে এসে টোকা মারে, জ্যোতির কপালের ওপর সেরকম মায়াবী টোকায় শুশ্রূষা করতে চায় জ্ঞানদার আঙুলগুলি।
নীরবতা ভেঙে রবি হঠাৎ মেজোবউঠানের দিকে আঙুল তুলে গেয়ে ওঠেন, হেদে গো নন্দরানী/আমাদের শ্যামকে ছেড়ে দাও
রবি দু-তিনবার গাওয়ার পরেই গান-পাগল ভাইঝিরা তার সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করে। নতুন গান তুলে নেওয়ার আশ্চর্য গুণ আছে ওদের। প্রবির কিন্নরকণ্ঠের সঙ্গে বিবি আর প্রতিভার রিনরিনে সুরেলা গলা মিশে উদ্বেগভরা সন্ধেটা আবার মনোরম হয়ে ওঠে।
.
কিছুদিনের মধ্যেই জোড়াসাঁকো থেকে খবর এল রবির বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা। কার্তিক মাসের শেষের দিকে কারোয়ার থেকেই জাহাজে বোম্বাই এসে রেলপথে কলকাতায় ফিরে এলেন রবি, জ্যোতি ও কাদম্বরী। কী এক বিচিত্র কারণে জ্ঞানদা রবির বিয়েতে যেতে চাইলেন না। সৌদামিনীও কারোয়ারে থেকে গেলেন।
বিয়ে করতেই হবে অথচ বিয়ে নিয়ে রবির দুশ্চিন্তা কমে না। তার মধ্যেই বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে নিজের বিয়ের নেমন্তন্নের চিঠি পাঠিয়ে জানালেন, আগামী রবিবার ২৪শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান্ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬নং যোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন। ইতি। অনুগত। শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবির গায়েহলুদ হয়ে গেল সাদামাটাভাবে। তারপরেই ও-বাড়িতে আইবুড়োভাত খেতে যেতে হল মেজোকাকিমার কাছে। মেজোকাকিমা যোগমায়া নিজেও যশোরের মেয়ে, তার ওপর ভবতারিণী তার দূর সম্পর্কের বোন। তিনি তাই এই সম্বন্ধে খুব খুশি।
পাঁচ নম্বর বাড়ির তিন ভাইপো অবন গগন সমরেরাও রবিকা আসছেন বলে উত্তেজিত হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। সবুজরঙের নকশা করা জমকালো দৌড়দার শাল গায়ে দিয়ে রবি যখন খেতে এলেন, ভাইপো অবনের মনে হল যেন দিল্লির বাদশা এসেছেন। ঘরে থরে থরে অন্নব্যঞ্জন সাজানো, সুচিত্রিত পিঁড়ি পেতে রবিকে বসানো হল। তাকে ঘিরে যত দিদি, বউঠান, কাকিমার দল প্রশ্নের বাণ ছোটাচ্ছেন, কী রে বউ পছন্দ হল?
কী রে রবি, বউ কেমন হবে?
রবি লজ্জায় মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছেন, উত্তর দিচ্ছেন না। মনে মনে তিনিও ভাবছেন, সত্যি তো, বউ কেমন হবে?
রবির বিয়ে হল খুব সাধারণভাবে। রবি এ ঘর থেকে একটু হেঁটে ও ঘরে গেলেন বিয়ে করতে, নিজেরই বাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে অন্দরে এলেন। ঠাকুরবাড়ির নিয়মমতো কনেপক্ষকে কলকাতায় এসে বিয়ে দিতে হল, বিয়ে হল জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই।
কোনও ধুমধাম নেই। শুধু দু-একজন বন্ধুবান্ধব। বাড়ির লোকেরা আর শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন। রবির বিয়ের সাজ বলতে পারিবারিক একটি বেনারসি শাল, যার যখন বিয়ে হয় তিনি গায়ে দেন বরসজ্জার উপকরণ হিসেবে। রবি এসে দাঁড়ালেন সিঁড়ির ওপরে, কালোডুরে বেনারসি পরা এক আত্মীয় বরণ করে নিলেন তাঁকে।
কনেকে অন্দরে এনে সাতপাক ঘোরানো হলে বরকনে চললেন বাইরের দালানের সম্প্রদানস্থলে। সম্প্রদানে বাড়ির মেয়ে বউরা যায় না, শুধু ছোটরাই সাক্ষী রইল।
বাসরে বসেই রবি নিজের স্নায়বিক উত্তেজনা ঢাকার জন্য ঠাট্টাতামাশা শুরু করলেন। মেয়েরা অনেক যত্ন করে ভাঁড়কুলো খেলার আয়োজন করেছে, বরকনেকে ঘিরে খেলতে বসেছে আর খেলার শুরুতেই রবি সব ভাঁড় উপুড় করে খেলা পণ্ড করে দিলেন। কিছুতেই যেন তাঁর মন বসছে না।
মেয়েবউরা সব হইচই করে ওঠেন। ছোটকাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বলে উঠলেন, ও কী করিস রবি? এই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?
রবি চারদিকে তাকিয়ে নতুনবউঠানকে কোথাও দেখতে পান না। ছটফট করে বলে ওঠেন, কী করব ছোটকাকিমা, দেখছ না, সব যে উলটো পালটা হয়ে যাচ্ছে! আমি তাই নিজেই ভাঁড়গুলো উলটে দিচ্ছি।
কোথায় গেলেন নতুনবউঠান? রবির বিয়ে আর তিনিই নেই? বিয়ের পিঁড়ি ছেড়ে তাকে খুঁজে আনতে চান রবি, কিন্তু পরক্ষণেই বালিকাবধূর ঘোমটা ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন এর তো কোনও দোষ নেই! মেয়েরা সবাই তাঁকে গান গাইতে সাধাসাধি করছে। ছোটকাকিমাও। হঠাৎই রবি নববধূর দিকে তাকিয়ে যেন দুষ্টুমি করে নদিদির লেখা একটি গান গেয়ে ওঠেন,
আ মরি লাবণ্যময়ী/ কে ও স্থির সৌদামিনী/
পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে/ মার্জিত বদনখানি!
নেহারিয়া রূপ হায়,/ আঁখি না ফিরিতে চায়,/
অঙ্গরা কি বিদ্যেধরী/ কে রূপসী নাহি জানি।
বেচারি রোগা শ্যামলা গাঁয়ের বধূটি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে আরও বড় করে ঘোমটা টানেন। কার সঙ্গে তার বিয়ে হল, কোথায় এসে পড়লেন, কিছুই তিনি জানেন না। রবি আরও দু-একটি গান গাইলেন, কিন্তু আসর যেন কিছুতেই জমল না। কোথায় গেলেন জ্যোতিদাদা, কোথায় নতুনবউঠান? মেজদাদা মেজোবউঠানই বা কেন এলেন না, রবি বুঝতে পারেন না। যে বাড়ির খিলানে খিলানে সৃষ্টির উল্লাস ভেসে বেড়ায়, রবির বিয়ের দিনে কেন যেন সেই সুর বাজল না।