আরেকপ্রস্থ হইচই শুরু হল কারোয়ারে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে। কাশিয়াবাগানে আর জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানায় দরজি বসেছে। নানারকম পোশাক সেলাই করতে। কাদম্বরী স্বর্ণকুমারীরা নতুন নতুন ডিজাইনের জ্যাকেট করতে দিয়েছেন। ঠাকুরবাড়ির একটা বড় দল মিলে কারোয়ার বেড়াতে যাওয়া ঠিক হয়েছে। সদর স্ট্রিটের দল অর্থাৎ জ্যোতি, রবি ও কাদম্বরী, কাশিয়াবাগান থেকে জানকী ও স্বর্ণকুমারী, জোড়াসাঁকোর সৌদামিনী ও প্রতিভা সবাই যাবেন। কর্নাটকের পাহাড় ঘেরা এই অপরূপ সমুদ্রশহর এখন সত্যেনের কর্মস্থল।
রবির মনে আসন্ন বিয়ের চাপ। পারবেন কি মানিয়ে নিতে? সমুদ্রতীরে হাঁটতে হাঁটতে কাদম্বরীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলেন তিনি, কোথাকার কোন এক বালিকা এসে জীবনটাকে বদলে দেবে! সেই ভীরু গ্রামবালিকার সঙ্গে কী কথা বলব নতুনবউঠান?
সমুদ্রের ঢেউ এসে প্রবল কোলাহলে আছড়ে পড়ে রবির পায়ের কাছে, যেন তারা রবিকে আশ্বাস দিতে চায়।
প্রথম সমুদ্র-দর্শনে এসে কাদম্বরীর মন খুশি খুশি। তিনি রবির গালে টোকা দিয়ে বলেন, আহা, বউয়ের সঙ্গে কী কথা বলবে তা আবার শিখিয়ে দিতে হবে নাকি? ও তো সরলা ইন্দিরাদের বয়সি, ওদের সঙ্গে এত কথা বল আর বউয়ের সঙ্গে পারবে না?
না বউঠান, তুমি বুঝতে পারছ না, রবির গলায় উদবেগ, কথা বলার আগে তো তাকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করে নিতে হবে! আমার এত সময় কোথায়? বিবি, সরলা তো আমাদের মেয়ে, আমাদের বাড়ির আবহাওয়ায় বড় হয়েছে। তাদের সঙ্গে সেই বালিকার তুলনা?
সে তো হবেই। কাদম্বরী বলেন, শোবার ঘরের সেই শিক্ষানবিশিটাই তো সবচেয়ে রোম্যান্টিক। আমি তো প্রথম প্রথম সারাদিন অপেক্ষা করে থাকতাম সেই পাঠশালার জন্য, কখন তোমার নতুনদাদা এসে আমাকে মেঘদূত পড়াবেন, কখন গান শেখাবেন পিয়ানো বাজিয়ে!
বহুদিন আগে হঠাৎ দেখে ফেলা জ্যোতিদাদা ও নতুনবউঠানের একটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের স্মৃতি মনে পড়ে রবির বুকে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। আকুল হয়ে কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, তখন আমাকে তোমরা কোনও গুরুত্ব দিতে না, আমার খুব ঈর্ষা হত জানো! আমার বউ এলে তুমি দূরে চলে যাবে না তো, নতুনবউঠান?
হাঁটতে হাঁটতে ওঁরা অনেক দূর চলে এসেছেন, যেখানে গিরিবন্ধুর উপকূলরেখার মধ্য দিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে এসে মিশেছে শীর্ণতোয়া কালানদী। একটু পেছনেই শোনা যাচ্ছে বিবি ও প্রতিভার সোনাঝরা গলার গান, স্বর্ণ সৌদামিনী-জ্ঞানদার কলকাকলি। তীরে বসে পড়ে বালি নিয়ে খেলতে থাকেন কাদম্বরী। রবিও বসে পড়েন পাশে, বালুচরে আঁকিবুকি করতে করতে কী যেন লিখছেন। কাদম্বরী মুখ বাড়িয়ে দেখেন বালির অক্ষরে লেখা, হেকেটি ঠাকরুন।
বিষণ্ণ মুখ তুলে তিনি বলেন, এবার তুমি হেকেটিকে ভুলে যাবে রবি, এখন যে অন্য কোনও ঠাকরুন আসছেন!
কী বলছ বউঠান, রবি আঁতকে ওঠেন, তোমার জন্য আমি বিলেত যাওয়া বাতিল করেছি, তোমার জন্য মেজোবউঠানের শত ডাকাডাকিতেও তাঁর বাড়ি থাকতে যাই না, তোমার দু নয়নে উৎসর্গ করেছি আমার রাশি রাশি কবিতা। কাদম্বরীর হাতদুটি বালি থেকে তুলে নিয়ে নিজের হাতে চেপে ধরেন রবি।
হইচই করে ছুটে এসে ওঁদের জড়িয়ে ধরে বিবি ও প্রতিভা। পেছনের বড়দের দলটিও পৌঁছে যায়। বালির ওপর গোল হয়ে বসে শুরু হয় অন্য এক আড্ডা।
কাদম্বরীর দিকে রবির বাড়তি মনোযোগ জ্ঞানদা লক্ষ করেন। কী এত কথা ওদের? কাদম্বরী যেন দিনদিন গ্রাস করে ফেলছে রবিকে। কাঁচা মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন হেকেটি ঠাকরুন। বলেই ফেলেন তিনি, তোমরা অমন আলাদা হয়ে যাও কেন রবি? আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বুঝি একেবারেই ভাল লাগে না?
অমন অন্যায় অভিযোগ কেন মেজোবউঠান, রবি বলেন, আমার আর নতুন বউঠানের হাঁটার জোর একটু বেশি, তাই বুঝি রাগ করেছ?
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কোরো না রবি, জ্ঞানদা ছাড়বার পাত্রী নন, আসলে কাদম্বরী আমার সঙ্গে মিশতে দিতে চায় না, ওর কান্নাকাটির ভয়েই আমার বাড়িতে তুমি থাকতে পার না। ব্রাইটনে থাকতে তুমি আমাদের সঙ্গে কত গল্প করতে!
সৌদামিনী সকলের দিদি, তিনিই এখন জোড়াসাঁকো বাড়ির গৃহকত্রী, সবাইকে নিয়ে চলতে চান। জ্ঞানদাকে থামিয়ে আস্তে করে বললেন, আঃ মেজোবউ।
কাদম্বরী কিন্তু চুপ করে থাকতে পারলেন না, দেখছ তো বড়ঠাকুরঝি, মেজদি কেমন করে বলছেন! এজন্যেই তো আলাদা আলাদা হাঁটছিলাম। আমার ঘরে শান্তি নেই, সমুদ্রের ধারে এসেও কি দুদণ্ড শান্তি পাব না?
স্বর্ণকুমারী সকলের মধ্যে থেকেও উদাসিনী। সমুদ্রের দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই তিনি বলেন, এত উদার, বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়েও তোমরা এমন তুচ্ছ বিষয়ে কথা বলছ কেন!
কোনও কিছু ভাল লাগে না কাদম্বরীর। পেছন ফিরে সমুদ্রের ধার দিয়ে জোরে হাঁটতে থাকেন। বিবি প্রতিভারা লঘু পায়ে তার পেছনে দৌড়য়। বাধা হয়েই রবি জ্ঞানদা সৌদামিনী স্বর্ণকুমারীরাও তার পিছু পিছু বাংলোর দিকে ফিরতে শুরু করেন। সারাটা রাস্তায় সমুদ্র গর্জন করে এই অশান্তির প্রতিবাদ জানায়।
জজসাহেব সত্যেনের এই বাংলোটি খাঁটি বার্মাটিকে তৈরি বিশাল প্রাসাদের মতত। সমুদ্র প্রতি মুহূর্তে পায়ের কাছে ছলাৎ ছলাৎ সেলাম জানিয়ে যায়। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় শুধু জলধ্বনির মাঝে নিঝুম বসে থাকেন জ্যোতিরিন্দ্র। মায়াবী সমুদ্রের ধরা না দেওয়া ভঙ্গি দেখে তার তীব্রভাবে বিনোদিনীর মুখ মনে পড়ছে। মুখ, চোখ, স্তন, কোমর সব স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার সেই অনিন্দ্যসুন্দর অঙ্গে শয়তান গুরমুখের থাবা পড়েছে। তার মনেও কি সে জায়গা পেয়েছিল? এই অপরূপ সমুদ্রতীর, এই তারাখচিত রাত্রি কিছুই যেন মনে ছাপ ফেলে না জ্যোতির, তার এখুনি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে বিনোদিনীর কাছে। মাইল মাইল দূরত্ব পেরিয়ে, সমুদ্রের নোনা বাতাস ভেদ করে বিনোদের শরীরের ঘ্রাণ নাকে এসে পাগল করে তোলে জ্যোতিকে।