ওদিকে, সারা যশোর চষে ফেলেও ভবতারিণীর চেয়ে পছন্দসই কোনও মেয়ে খুঁজে পেলেন না জ্ঞানদা। অগত্যা বেণী রায়ের মেয়ের সঙ্গেই রবির বিয়ে দেওয়া হবে, মোটামুটি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যশোর ছাড়লেন ঠাকুর পরিবার। রূপাও চোখের জলে হ্যারির কাছে বিদায় নিল।
রবি অবশ্য জোড়াসাঁকোয় ফিরে বিয়ে নিয়ে ফের দোনোমনো করছিলেন। জ্যোতির কাছে খবর পেয়ে দেবেন ঠাকুর জরুরি তলব করলেন রবিকে মুসৌরিতে। এবার ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে রবির সঙ্গী হল বিবি আর সুরেন। প্রিয় দুই বালক বালিকার সঙ্গে অনর্গল গান, কথা, দুষ্টুমি, খুনসুটিতে রবির যাত্রাপথটি বেশ ছেলেমানুষি রোমাঞ্চে ভরে উঠল। এ-যাত্রায় তাদের সঙ্গে কোনও দাসীচাকর ছিল না। তাই খাওয়াদাওয়ার পর কখনও ট্রেনের টয়লেটে গিয়ে এঁটো বাসন ধুতে হচ্ছে বিবিকে আর কখনও সুরেন গিয়ে খাবার কিনে আনার চেষ্টা করছে। জীবনের এ-সব অনিবার্য শিক্ষার মধ্যে দিয়েই তারা স্বাধীনতা উপভোগ করছে।
এবারে মহর্ষি বিয়ে না করার জন্য রবিকে ধমক দিলেন। এভাবে বসে থাকলে চলবে না, সংসারী হয়ে পারিবারিক কাজকর্মে মনোযোগ দিতে হবে, জমিদারির কাজ শিখতে হবে। এরপর আর রবির কোনও আপত্তি টেকেনি, ঠাকুরবাড়ির সরকারি খাতায় রবিবাবুর বিয়ের হিসাব লেখা শুরু হয়ে গেল। যশোরে দূত পাঠিয়ে পাকা কথার সঙ্গে আশীর্বাদী পাঠানো হল হিরের গয়না ও পুতুল।
.
শহর কলকাতা তখন আদালত অবমাননার দায়ে সুরেন্দ্রনাথের দুমাসের কারাবরণ ও মুক্তির তামাশা নিয়ে উত্তাল। মুক্তির পর তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল নিমতলার ফ্রি চার্চ কলেজে। দেশপ্রেমের জোয়ারে ছাত্রদল ও তরুণেরা সুরেন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে নিল। জনসভায় রবি সুরেন্দ্রনাথের জন্য কয়েকটি নতুন গান গাইলেন।
কিন্তু রবির কোনও লেখায় ঘটনার উল্লেখমাত্র না দেখে অনেকেই ভুরু তুললেন। বিশেষত পরিবারের মধ্যে থেকেই স্বর্ণকুমারী প্রশ্ন করলেন, রবি তোর কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করে লেখা উচিত ছিল!
রবি বিরক্ত হন, নদিদি, তোমার আর আমার ভাবনা যে সব সময়ে এক হবে এটা ধরে নিচ্ছ কেন? ওঁর জন্য গান লিখে গাইলাম তো, আবার প্রতিবাদ করে লিখতে হবে তার কী মানে আছে? কোনওকিছুতেই এত বাড়াবাড়ি আমার পছন্দ নয়।
কট্টর জাতীয়বাদী জানকীনাথ এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী। জানতে চান, কেন রবি, বাড়াবাড়ি কীসে দেখলে?
রবি হাসেন, এই যে তোমাদের বাচ্চা মেয়ে সরলা আর তার বন্ধুদের এমন দেশপ্রেম জেগেছে যে এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রোজ কালো ফিতে হাতে বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে, এটা বাড়াবাড়ি না? ওরা পলিটিকসের কী বোঝে? আমি তো শুনেছি, বেথুনের উঁচু ক্লাসের ওর দুই মন্ত্রদাত্রী কামিনী রায় ও অবলা বসু যা শেখান ওরা অন্ধের মতো তাই অনুসরণ করে। এতে অহেতুক উত্তেজনা ছড়ায় কিন্তু প্রকৃত দেশপ্রেম জাগে না।
স্বর্ণ রুষ্ট হয়ে বলেন, যাই বল রবি, আমি তোর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। সরলা এর মধ্যে এত কাণ্ড করেছে জানতাম না ঠিকই, কিন্তু শুনে আমার রীতিমতো গর্ব হচ্ছে।
কিন্তু এ-সব বাড়াবাড়িতে আমার মন সায় দেয়না। ছাত্রসমাজের কাছে জাতীয়তা যেন গভীর উপলব্ধি না হয়ে নিছক হুজুগ হয়ে উঠছে। আর এই উপলক্ষে বাংলা সংবাদপত্রগুলি যেভাবে রুচিহীন ইংরেজ-নিন্দায় মেতে উঠেছে তাও তো অসহ্য। ভদ্রলোকের তিরস্কারই বা ভদ্রভাষায় হবে না কেন? রবি প্রশ্ন তোলেন।
স্বর্ণ ও জানকী নিজেদের কাজের বাইরে সারাদিন মেতে থাকেন জাতীয়তা আর থিওসফির চর্চায়। দুটো বিষয়ের মধ্যে কোনও সম্বন্ধ নেই, কিন্তু দুটিতেই স্বামী-স্ত্রীর সমান উৎসাহ। একদিকে জানকীর কংগ্রেসি রাজনীতি আর অন্যদিকে থিওসফিকাল সোসাইটির পরলোকচর্চা।
মহিলা থিওসফিকাল সোসাইটির সভাপতি হয়েছেন স্বর্ণ। তাঁর কাশিয়াবাগানের বাড়িতেই জড়ো হন সবাই, যেসব মহিলাদের স্বামী বা বাড়ির পুরুষরা থিওসফিস্ট তারাই সদস্যা। কলকাতার অভিজাত পরিবারগুলির অনেক মহিলার সঙ্গে এভাবে বন্ধুত্ব হয়েছে স্বর্ণকুমারীর। থিওসফিকাল সোসাইটির দুই প্রতিষ্ঠাতা মাদাম ব্লাটাভস্কি ও কর্নেল অলকট প্রায়ই আসেন। তারা মেয়েদের দীক্ষা দেন, মহিলারা তাঁদের স্থান দেন ভগবানের পরেই।
একদিন রবি গিয়ে দেখলেন সবাই হলঘরে বসে আছেন। অলকট সাহেব কী একটা কথা বলতে বলতে শো করে হলঘরের পাশের শোবার ঘরে চলে গেলেন, দু-এক মিনিট পরে ফিরে এসে বললেন যে, মহাত্মা কুথোমির আবির্ভাব হয়েছিল ওই ঘরে, তিনি তার বার্তা শোনার জন্য ডাক পাঠিয়েছিলেন অলকটকে, শুনিয়ে চলে গেছেন।
উপস্থিত মহিলারা বিস্ময়ে আনন্দে শিউরে উঠলেন, স্বর্ণ যেন দিব্যবিভায় আলোকিত হয়ে উঠলেন। মহাত্মা কুথোমির অলৌকিক আবির্ভাবে পবিত্র হয়ে গিয়েছে তার ঘরবাড়ি। তার বড় মেয়ে হিরন্ময়ী তো দীক্ষিত হয়েছেই, পরিবেশে এমন অপার্থিব আবেশ তৈরি হয়েছে যে বাচ্চা সরলাও আবদার করতে লাগল দীক্ষা নেওয়ার জন্য। রবি নিজেও একটু-আধটু পরলোকচর্চা করেন, প্ল্যানচেটে তার তীব্র আগ্রহ। কিন্তু থিওসফিকাল সোসাইটির এই আবহ তার কাছে ভাঁওতাবাজি মনে হল। নদিদি কী করে এ-সবের মধ্যে ডুবে গেলেন কে জানে! ক্রমশই তার সঙ্গে রবির মনের অনেক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তিনি কাশিয়াবাগান থেকে নিঃশব্দে পালিয়ে এলেন।