ঘন মেঘের মতো পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্য রবি বলেন, না বউঠান, আমার আর বিয়ে করার জন্য তর সইছে না, গান না জানুক, লেখাপড়া শিখুক না শিখুক, কাল সকালে উঠে যে মেয়েকে দেখবে তার গলাতেই ঝুলিয়ে দাও আমাকে। আর পণ্ডিতেরা তো স্ত্রীলোককে লেখাপড়া শেখাতে বারণ করেন, ঘরের বউ একবার নাটক-নভেল পড়া ধরলে তার সংসারধর্ম নাকি লাটে ওঠে!
কাদম্বরী হাত বাড়িয়ে চুল ধরে নেড়ে দিয়ে বলেন, দাঁড়াও, তোমার পণ্ডিত ভজনার ফল দেখাচ্ছি।
রবির হাতে একটি পত্রিকা, তিনি হাসতে হাসতে সরে গিয়ে বলেন, দেখো জ্যোতিদাদা, সেই তোমার লাজুক বালিকাবউটি লেখাপড়া শিখে কেমন মারমুখি হয়ে উঠেছে। ঠিকই লিখেছেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, শোনো, পড়ে শোনাই, ছেলেরা ইংরাজী শিখিয়া সাহেব হইয়াছেন, মেয়েরা ইংরাজী না শিখিয়াই বিবি হইতে বসিল। গৃহ এবং গৃহোপকরণ অপরিচ্ছন্ন থাকে, খাওয়া দাওয়া খারাপ হয়, শরীর মাটি হইয়া যায়…–
ইস, তাই বইকী! কাদম্বরী ফুঁসে ওঠেন, লেখাপড়া না শিখলে পরিচ্ছন্নতা ব্যাপারটাই বোঝা যায় না, এটা তোমাদের ভূদেববাবুকে সামনে পেলে বুঝিয়ে দিতাম।
জ্ঞানদাও হাসতে হাসতে যোগ দেন, ভূদেববাবুদের জন্যই এ দেশের মেয়েদের উন্নতি আটকে আছে। ওঁদের একবার বিলেতে ঘুরে আসার দাওয়াই দেওয়া দরকার, তা হলে দেখতে পেতেন শিক্ষিত মেয়েরা ঘরকন্না করবে না– এ ধারণা কত ভুল। বরং ওদের কাছেই আমরা গুছিয়ে সংসার করার পাঠ নিতে পারি। রবি একটু কড়া করে এ-সব লেখার জবাব দিতে পার না!
জ্যোতিরিন্দ্র হাসতে থাকেন, রবিকে বলছ মেজোবউঠান, রবি সেই যে বিলেতের মেয়েদের ভূরি ভূরি প্রশংসা করে ভারতীতে লিখেছিল, তাই পড়েই তো বাবামশাই ভয় পেয়ে গেলেন, রবি না আবার মেম বিয়ে করে বসে! সেজন্যই রবিকে মাঝপথে পড়া থামিয়ে দেশে ফেরার হুকুম দিলেন। আবার ওকে লিখতে বলছ!
রবি হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে লিখতে হবে কেন, এখন তো তোমাদের মধ্য থেকেই সরস্বতী বীণাবাদিনীরা বেশ প্রতিবাদ করে লিখছেন, আমাদের ভারতীতে লাহোরিণীর লেখাই বা কম কীসে?
সেই লেখার জন্য শ্বশুরবাড়িতে ওকে অনেক নিমেন্দও শুনতে হয়, কাদম্বরী বলেন। অথচ ও তো সত্যি কথাই লিখেছে। মেয়েদের পোশাক আশাক কী রকম হবে তা কেন পুরুষেরা ঠিক করে দেবেন?
জ্ঞানদা কাদম্বরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আচ্ছা, নতুনবউ, তুমি ভাবো তো, যে রবি বিলিতিবালাদের দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিল, তার এখন এই গ্রামবাংলার ভবতারিণীকে কি পছন্দ হবে? রবি আবার ভবতারিণীর পোশাক ডিজাইন করতে চাইবে না তো?
তা হলে আর তুমিই বা কেন গ্রামবাংলায় ছুটে এলে মেজোবউঠান? রবি কাদম্বরীকে বাঁচাতে চান, আমার বিয়ের জন্য সরাসরি বিলেতের গোরিমেম খুঁজলেই পারতে!
তা হলে তোমার ভবতারিণীকে খুব পছন্দ হয়েছে বলো? জ্ঞানদা গোমড়া মুখে বললেন, তোমাদের দেওর-বউঠানের যখন এত পছন্দ, তা হলে আমিই বা মেয়ে খুঁজে মরি কেন? যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!
কিংবা বলা যায়, যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই। জ্যোতি ফোড়ন কাটেন, মেজোবউঠান, তুমি বরং ভবতারিণীকে বেশ করে সর-ময়দা মাখানোর ব্যবস্থা কোরো, যেমন মা তোমাদের মাখাতেন!
মুখ দেখে রবি বুঝতে পারেন মেজোবউঠান চটেছেন। দুই জায়ের মন কষাকষিতে তিনি যে কাদম্বরীর পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন! তাড়াতাড়ি জ্ঞানদার পায়ের কাছে বসে পড়ে মানভঞ্জনের জন্য তিনি বলেন, হে দেবী, তুমি ক্রুদ্ধ হলে সামান্য এই মানবসন্তান আর বিয়েই করবে না। এই দুষ্টু বালিকাকে বিয়ে করতে আমার বয়েই গেছে। বিয়েতে কাজ নেই, তার চেয়ে চলো যশোরের ভ্যাপসা গ্রামপথ ছেড়ে আমরা সেই মেঘাচ্ছন্ন ব্রাইটন ভিলায় ফিরে যাই।
.
যশোরের পথে আচমকাই একদিন রবি ও জ্যোতির দেখা হয়ে গেল হ্যারিসাহেবের সঙ্গে। চুল উসকোখুসকো, উদাস উদাস ভাব। তাঁর সঙ্গে আরও উসকোখুসকো একটি কিশোর। জানা গেল সে ছেলেটি স্বদেশি করে। হ্যারি এই স্বদেশি দলটার সঙ্গে খুব জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁরা গ্রামের মানুষের। সাহায্য সমর্থনও জোগাড় করতে চান।
হ্যারিকে নিয়ে রবি জ্যোতিরা কুটুমবাড়িতে পৌঁছতেই রূপা কোথা থেকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল, হ্যারিকে দেখে তার আনন্দ আর ধরে না। হ্যারি যেভাবে এদেশের স্বরাজের জন্য স্বদেশিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, তাতে গর্বে বুক ভরে ওঠে রূপার। কিন্তু এত লোকের মাঝে কোনও কথাই বলা সম্ভব নয়, আর পাড়াগাঁয়ে পুরুষের সঙ্গে কথা বলায় আরও কড়াকড়ি। দু-একটি কথা বলেই কাদম্বরীর রক্তচক্ষুর ভয়ে ভেতরে চলে যেতে হল তাকে।
চা-জলখাবার দেওয়ার অছিলায় রূপা আরও একবার বৈঠকখানাঘরে এল। হ্যারি একটি চিরকুট গুঁজে দিলেন তার হাতে। দুরুদুরু বুকে রূপা চিরকুট নিয়ে সোজা পুকুরপাড়ে চলে যায়, খুলে দেখে কাল দুপুরে পাড়ার পোডোমন্দিরের পেছনে দেখা করতে বলেছেন হ্যারি। রূপার রক্তে বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে।
আরও যে কদিন ঠাকুর পরিবার যশোরের কুটুমবাড়িতে রইলেন, রূপা আর হ্যারির গোপন অভিসার ততদিনই চলতে লাগল। প্রেমের ঘোড়া যত ছুটল ততই বেগবান হয়ে উঠল ওদের বিপ্লবের স্বপ্ন। হ্যারির ঝুলি থেকে বেরনো লালশালুতে মোড়ানো গীতার ওপর হাত রেখে, অজানা ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করে, পোডোমন্দিরের ভাঙা সিঁড়িতে বসে ওরা আজীবন পাশে থাকার শপথ নিল।