জ্যোতিও হাসতে হাসতে বলেন, হ্যাঁ, যশোরের কোনও এক মেয়ে নিশ্চয় রবির জন্য তপস্যা করছে, রবি তাকে উদ্ধার করবে বলে।
জ্যোতি, রবি, জ্ঞানদা, কাদম্বরী সবাই দল বেঁধে জ্যৈষ্ঠমাসের ভ্যাদভ্যাদে গরমে যশোের রওনা দিলেন, সঙ্গে চলল রূপা, বিবি, সুরেন আর দাসদাসী বামুনঠাকুর। আস্তানা নেওয়া হল জ্ঞানদার ভাইদের বাড়িতে। প্রায় প্রতিদিনই চেঙ্গুটিয়া, দক্ষিণডিহি ইত্যাদি আশেপাশের নানা জায়গায় পালকিতে, নৌকোয় কনে দেখার পর্ব চলল। কিন্তু যশোরে এবার যেন পাত্রী কম পড়েছে, কাউকে আর বউঠানদের মনে ধরে না।
জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসানির সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। এদিককার গ্রামের রাস্তাঘাট কাদামাখা, পিছল। মেয়েরা সাধারণত পালকিতেই যাতায়াত করছেন, কাছাকাছির মধ্যে হলে রবি-জ্যোতিরা পাড়ার অন্য পুরুষদের সঙ্গে পায়ে হাঁটেন। ঠাকুরবাড়ির লোকেদের এমন রাস্তায় চলাফেরা করার অভ্যেস নেই বলেই প্রতিপদে পড়ে যাবার আশঙ্কা।
সেই আশঙ্কাই একদিন সত্যি হল, দক্ষিণদিহি গাঁয়ের এক পাত্রী দেখার অভিযানে পেছল রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন স্বয়ং পাত্র। লখনউ চিকনের বাহারি আচকান ও ঢাকাই চাদরে সুসজ্জিত রবির সারা গা কাদায় মাখামাখি। নতুনবউঠানের স্বহস্তে নকশা করা কার্পেটের জুতোজাড়া আর খুঁজেই পাওয়া গেল না। আর কী আশ্চর্য, রবির এহেন দুর্বিপাকে কে একটা মেয়ে যেন আশপাশ থেকে হেসে উঠল। বিব্রত রবির মনে হল, কোথা হইতে এক সুমিষ্ট উচ্চকণ্ঠে তরল হাস্যলহরী উচ্ছ্বসিত হইয়া নিকটবর্তী অশথগাছের পাখিগুলিকে সচকিত করিয়া দিল।
সকলেই রবিকে টেনে তুলতে ব্যস্ত, পেছনের পালকি থেকে বউঠানেরা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ হাসির উৎস খোঁজারও চেষ্টা করছে। বেচারা রবিরও চোখে পড়ল, একরাশ নতুন ইটের পাঁজার ওপর বসে একটি মেয়ে হাসির চোটে এখনই শতধা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। একজন ছুটে গিয়ে অপরাধী বালিকাকে ধরে নিয়ে এল।
দেখা গেল লোকটি ঠাকুরবাড়ির কাছারির কর্মচারী বেণী রায় মশাই, আর মেয়েটি তারই বালিকা কন্যা ভবতারিণী। বেণী ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। গাঁয়ের রাস্তায় হঠাৎ মনিবদের দেখে তিনি যেমন আপ্লুত, কন্যার অশিষ্ট আচরণে তেমনই সংকুচিত। জ্যোতি আর রবিকে তিনি নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য পেড়াপেড়ি শুরু করলেন। বিশেষত, রবিবাবুর পোশাক বদলানো দরকার। ছোটবাবুর উপযুক্ত জামাকাপড় না দিতে পারলেও পরিষ্কার ধুতিচাদর তো বেণী রায় দিতে পারবেন!
জ্যোতি ভেবে দেখলেন, কথাটা ঠিক। রবি এরকম কাদা মেখে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, এ অবস্থায় তো পাত্রীর বাড়ি যাওয়াও যাবে না। অগত্যা সদলবলে বেণী রায়ের বাড়িতে হাজির হলেন তারা। সেখানে গিয়ে বেণীর মেয়ের কীর্তি সবিস্তারে জানতে পেরে হেসে কুটিপাটি হতে থাকলেন জ্ঞানদা ও কাদম্বরী। তাদের সামনে অবশ্য বেশ সাজিয়ে গুজিয়েই নিয়ে আসা হল ভবতারিণীকে।
মেয়েটি মন্দ নয়, কুটুমবাড়িতে ফিরে তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসে কাদম্বরী বলেন, সুন্দরী না হলেও বেশ সরল আর চটপটে মনে হচ্ছে। এর সঙ্গে রবিকে মানাবে ভাল।
জ্যোতি মজা করে বলে ওঠেন, এ-সব আশ্চর্য রহস্য কী করে বোঝ তুমি বউ? এ মেয়ের চেয়ে রূপসি কি রবির জুটবে না মনে কর?
জ্ঞানদাও খুঁতখুঁত করেন একটু, আর কটা মেয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেই হবে। ভবতারিণী তো গানও জানে না, লেখাপড়াও না!
কাদম্বরী একমত হন না, ও-সব শিখিয়ে নিলেই হবে, ঠাকুরবাড়ির বউরা আবার কবে কী শিখে এসেছে, জোড়াসাঁকোর পাঠশালাতেই আমাদের সব শিক্ষা।
জ্যোতি জানতে চান, এত মেয়ে দেখে শেষে একেই কী দেখে তোমার এত ভাল লাগল বলো তো? রবিকে বেকায়দায় ফেলেছে বলে?
কাদম্বরী বলেন, কেন দেখছ না, এ মেয়েটি অন্যদের মতো গেঁয়ো নয়, লজ্জায় একেবারে জড়ভরত হয়ে বসে থাকে না, সহজভাবে কথা বলতে পারে। একে বেশ শিখিয়ে পড়িয়ে মনোমতো করে গড়ে নেওয়া যাবে।
আসলে রবির সুন্দরী বউ আসুক কাদম্বরী তা চায় না, জ্ঞানদা হাসতে হাসতে ঢিল ছুড়লেন, বউ বেশি সুন্দরী হলে রবি তার নতুনবউঠানকে ভুলে যায় যদি!
জ্ঞানদার বাক্যবাণে কাদম্বরীর মনে লাগে। কী কুটিল মেজোবউ! তিনিও জবাব দিতে ছাড়েন না, তা কেন বলছ মেজদি, রবির বউয়ের সঙ্গে আমার কোনও প্রতিযোগিতা নেই। সে হবে আমার অতি আদরের। আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, তা যেন তাকে সইতে না হয়।
এবার জ্ঞানদার গায়ে হুল ফোটে যেন, শোনো নতুনবউ আমি যা যা। করেছি, আমি যা সয়েছি, তা তুমি সাতজন্মেও পারবে না।
রবি এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার আর পারেন না। বলে ওঠেন, দোহাই তোমাদের বউঠান, আবার শুরু কোরো না! এরকম করলে তো আমি বিয়েই করব না। বরং ভাবছি, এই মেয়ে দেখা কাণ্ড নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলব।
কাদম্বরী হাসতে হাসতে বলেন, শোনো রবি, তোমার সেই গল্পে পাত্রের কাদায় পড়ে যাওয়ার কথাটা লিখতে ভুলো না যেন!
আর তাই দেখে পাত্রীর খিলখিল করে হেসে ওঠার কথাটাও বাদ দিসনে যেন। জ্যোতি যোগ করেন।
তারপরেই কাদম্বরীর পিঠে হাত রেখে বলেন, শোনো বউ, তোমার এ মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে, ভাল কথা। আর দু-একটা মেয়ে দেখলে যদি মেজোবউঠানের শান্তি হয় তাতেই বা আপত্তি কীসের? তারপর না হয় ভাবা যাবে। রবির মতামতটাও তো শুনতে হবে আমাদের।