তুমি যদি চলেই গেলে, কোন ব্যবস্থা নিয়ে আমি সুখে থাকব? তা ছাড়া, বিনোদিনী উদবিগ্ন হন, তোমার সঙ্গে থাকার আগে একরকম ছিল, এখন যে দলের লোকেদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা পালটে গেছে। আমার জন্য তুমি দল গড়ে দিলে আর সেটার মালিক হল পাঁচভূতে। আমি এখন ফেলনা।
তা হতে দেব না বিনোদ, গুরমুখ দৃঢ়স্বরে বলেন, তুমি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছ আর স্টারের পেছনে তোমার ভূমিকা কতটা তাও আমি জানি। এবার আমার সব শেয়ার তোমার নামে ট্রান্সফার করে দেব। তুমি হবে স্টারের অংশীদার।
কিন্তু তা হল না। গিরিশরা হতে দিলেন না। একজন বারাঙ্গনার অধীনে কাজ করতে কেউই রাজি হলেন না। বিনোদিনীকে মানাতে না পেরে গিরিশ তার মায়ের কাছে গেলেন মধ্যস্থতার জন্য। বিনোদিনী গো না ছাড়লে সমূহ বিপদ। থিয়েটার লাটে উঠবে।
জলের দরে এগারো হাজার টাকায় স্টার কিনে নিলেন গিরিশের সহযোগী চার অংশীদার অমৃতলাল বসু, দাশুচরণ নিয়োগী, হরিপ্রসাদ বসু ও অমৃতলাল মিত্র। আবার বঞ্চিত হলেন বিনোদিনী।
পুরনো প্রেমিক চলে গেছে, গুরমুখ সরে গেল, গিরিশ ছলনা করলেন, নাটকের সহশিল্পীরাও দূরে সরে গেছে। রাশিরাশি ভক্ত দর্শকেরা আছে, কিন্তু রঙ্গপটের আলো নিভে গেলে তারাও মিলিয়ে যায়। নিজের মানুষ বলে কেউ নেই।
এই অবস্থায় মাত্র একজনের কাঁধেই মাথা রেখে কাঁদবার জায়গা খুঁজে পেলেন বিনোদিনী, তিনি জ্যোতিঠাকুর।
১৭. মৃণালিনী
রবির বিলাতযাত্রার দ্বিতীয় চেষ্টাও যখন ব্যর্থ হল, দেবেন ঠাকুর ঠিক করলেন তাঁর বিয়ে দেবেন। কাদম্বরী একটু সামলে উঠেছেন দেখে রবি তার ভাগনে সত্যকে নিয়ে এবার বিলেতের জাহাজেও উঠেছিলেন। কিন্তু যত জাহাজ দূরে যায়, ততই বাড়ির টান বাড়তে থাকে সত্যর মনে। যদিও দু-তিন বছর বিয়ে হয়েছে, তবু বউয়ের মুখ মনে পড়ে তার বুক হু হু করে। মাদ্রাজ পর্যন্ত গিয়ে সত্য বেঁকে বসল, আর যাবে না। তার নাকি পেটব্যথা, রক্ত আমাশা। এখান থেকেই সে কলকাতা ফিরবে। এই জাহাজে রবির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে আশুতোষ চৌধুরীর। রবি ফিরতে চান না, কিন্তু যখন আশু ও রবি মিলে প্রাণপণ চেষ্টাতেও সত্যকে আটকে রাখা গেল না, তখন তার সঙ্গে রবিও লটবহর গুটিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন।
নেমে পড়লেই তো হল না, এবার জবাবদিহির পালা। রবি ভয়ে ভয়ে বাবামশায়কে টেলিগ্রাম করলেন মাদ্রাজ থেকেই। দেবেন অপরাধী দুজনকে তক্ষুনি নির্দেশ দিলেন সোজা মুসৌরিতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। সুতরাং মাদ্রাজ থেকে সুরাটে সত্যেনের কাছে একদিন কাটিয়ে মুসৌরি পৌঁছলেন রবি।
দেবেন এখন বেশ কিছুদিন ধরেই পাহাড়ে থাকছেন। দার্জিলিং থেকে নেমে কলকাতা হয়ে নৌকো করে এসেছিলেন হরিদ্বার। তারপর দেরাদুন হয়ে মুসৌরিতে আশ্রয় নিয়েছেন বেশ কিছুদিন। মাঝে মাঝে সার্জেন ম্যাকলারেনের কাছে অর্শ, পায়ের ঘা ইত্যাদি চিকিৎসার জন্য দেরাদুনে নেমে আসেন, আবার ফিরে যান মুসৌরিতে। ছেলে আর জামাইরা এসে ঘুরে যান মাঝে মাঝেই। জ্যোতি এসে একমাস কাটিয়ে গেছেন। বর্ণকুমারীর স্বামী সতীশ স্কটল্যান্ড থেকে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে দেখা করতে এলেন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। জামাতার সাফল্যে খুশি হয়ে মহর্ষি মেয়ে-জামাইকে বারো হাজার টাকার চেক উপহার দিয়েছেন, নিজস্ব বাড়ি করার জন্য। টাকা দিয়েছেন স্বর্ণকুমারীকেও।
রবি ও সত্যকে বিশেষ বকুনি দিলেন না দেবেন্দ্রনাথ, সত্য যেতে পারবে কি না তা নিয়ে তিনি আগে থেকেই সন্দিহান ছিলেন। রবিকে বললেন, ব্যারিস্টার হওয়া যখন তোমার কপালে নেই, এবার বিয়ে করে সংসারী হও।
রবি মাথা নিচু করে নিরুত্তর বসে থাকলেন। তার মোটেই একটি নিরক্ষর বালিকাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। কিছুদিন বাবার কাছে কাটিয়ে ঘরে ফিরে এলেন তিনি।
শুরু হয়ে গেল রবির পাত্রী খোঁজার তোড়জোড়। জ্ঞানদার ইচ্ছে রবির উপযুক্ত বউ খুঁজে আনবেন তিনিই, তারপর তাকে ঘষেমেজে বিবির সঙ্গে কনভেন্ট স্কুলে পাঠাবেন। কাদম্বরীর আবার কনভেন্ট-চর্চায় আস্থা নেই, তিনি চান রবির বউকে কাব্যসাহিত্যের পাঠ দিতে। এবার আর দাসী পাঠিয়ে বউ খোঁজা হবে না, বউঠানেরা নিজেরাই রবির পাত্রী খুঁজতে যাবেন ঠিক করলেন। ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে এ এক নতুন ঘটনা।
এক ধনী মাদ্রাজি জমিদারের মেয়ের সঙ্গে রবির বিয়ের প্রস্তাব এল, মেয়েটি সাতলক্ষ টাকার উত্তরাধিকারিণী। দল বেঁধে জ্যোতি, জ্ঞানদা, কাদম্বরীরা রবিকে নিয়ে চললেন পাত্রী দেখতে। জমিদারগৃহে প্রথমেই দুটি অল্পবয়সি মেয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন। তার মধ্যে রূপসি, তুখোড় মেয়েটিকে সবার মনে ধরল। গান নিয়েও অনেক আলাপ করলেন মেয়েটি। চুপচাপ, সাধাসিধে অন্যজন সবার অলক্ষ্যে দামি কাপড়ে জড়ানো পুঁটুলির মতো বসে রইলেন। এরপর ঘরে এলেন গৃহকর্তা জমিদারমশাই। মদ্রজা রূপসিটিকে দেখিয়ে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই, হিয়ার ইজ মাই ওয়াইফ। আর জড়ভরত মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, হিয়ার ইজ মাই ডটার। অতিথিরা কোনওরকমে এ ওর সঙ্গে চোখাচোখি করে ভদ্রতা বজায় রাখলেন আর বাড়ি ফিরে হাসিতে ফেটে পড়লেন।
আহা, রবির খুব মনে ধরেছিল জমিদারগিন্নিকে, হেসে গড়িয়ে পড়েন কাদম্বরী। জ্ঞানদাও হাসিতে যোগ দিয়ে বললেন, এবার দেখছি আর ঝুঁকি না নিয়ে রবির জন্য মৃণালিনী খুঁজতে যশোরেই যেতে হবে।