ক্ষুব্ধ বিরক্ত হতাশ জ্যোতি বিনোদিনীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে পিছু ডেকেও ফেরাতে পারেন না বিনোদিনী।
.
টাকা দিয়ে বিনোদিনীকে কিনে নিলেন গুরমুখ। তার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা করে নেন গিরিশ। কিন্তু বিনোদিনী তখনও খুঁতখুঁত করছেন। গুরমুখের শর্তটা মানতে পারছেন না। মাঝে মাঝে সঙ্গ দেওয়া এককথা, কিন্তু একেবারে রক্ষিতা হয়ে থাকতে তার মন চায় না। একদিকে তার সামনে রঙ্গালয়ের তারাভরা আকাশ, আর তিনি সেই আকাশের পরি; অন্যদিকে কালিমাখা জীবনযাপনের জন্য রঙ্গকর্মীদের জোরাজুরি। রূপোপজীবিনীর অতীতকে পেছনে ফেলে যত তিনি উত্তরণ চান, তত যেন সবাই মিলে তাকে সেই পাঁকে ডোবাতে চাইছে।
ক্যালকাটা স্টার কোম্পানির দলবল মিলে তাকে কাতর অনুরোধ করে। শেষে গিরিশ তাকে ডেকে বললেন, আর কোনও উপায় নেই রে বিনোদ, তুই থিয়েটার ভালবাসিস, থিয়েটারের জন্যে আজ তোর নিজেকে বলি দিতে হবে।
গিরিশের সকাতর অনুরোধ মানে বিনোদিনীর কাছে আদেশ। তা ছাড়া, থিয়েটার যখন তার নামেই হচ্ছে, বিনোদিনী গুরমুখের বাসনায় নিজে বলিপ্রদত্ত হলেন। বিডন স্ট্রিটে জমি কেনা হল, আর কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করে রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল। নাম নিয়ে দরকষাকষি চলছিলই, শেষ পর্যন্ত। বিনোদিনীর আশা ছিল বিনোদিনী থিয়েটার না হোক, বি-থিয়েটার নাম হবে, গুরমুখ তাকে আদর করে সেই প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন।
কিন্তু গিরিশ, অমৃতলালেরা কিছুতেই তাতে রাজি হলেন না। বিনোদিনীর কাছে খবর পৌঁছল নাম রেজিষ্ট্রি হয়েছে স্টার থিয়েটার। যে জন্য তিনি নিজেকে বিকিয়ে দিলেন সেই থিয়েটারে তার নামের চিহ্নটুকু রাখা হল না, বিনোদিনী এত বড় প্রবঞ্চনায় ভেঙে পড়লেন। রিহার্সালেও তার প্রতি সকলের ব্যবহার যেন পালটে গেছে, কেউ তাকে আগের মতো খাতির করছে না। অপরাধবোধ ঢাকার জন্য গিরিশও যেন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিনোদিনীর চোখ ফেটে জল আসে। তিনি রিহার্সালে আসা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলেন।
গুরমুখ হতাশ হয়ে পড়েন, এত টাকা ঢেলে কি এক শোকার্ত রমণীর সেবা করবেন? কোথায় গেল বিনোদিনীর হাসিমুখ, চমক ধমক! গিরিশের কাছে গিয়ে খুব রাগারাগি করলেন একদিন।
গিরিশও বুঝতে পারছিলেন, বিনোদিনীর সঙ্গে খুবই অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে। থিয়েটারের শেয়ার দেওয়ার ব্যাপারটাও কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনই বিনোদকে বাদ দিলে চলবে না, কারণ গুরমুখ রেগে যাচ্ছে আর দর্শকেরা আজও তার জন্য পাগল।
গিরিশ বিনোদিনীকে একটু সাধাসাধি করে ফিরিয়ে আনলেন। বিনোদের অবস্থা তো একবার সাধিলেই খাইব গোছের। রিহার্সালে না গিয়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সব বঞ্চনা তিনি মানিয়ে নিলেন। বাড়ি ফিরে নিজের খাতায় লিখে রাখলেন, থিয়েটার ভালবাসিতাম তাই কার্য করিতাম, কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই।
১৮৮৩ সালের ২১ জুলাই স্টার থিয়েটারের উদবোধন হল গিরিশের লেখা দক্ষযজ্ঞ নাটক দিয়ে, সতীর ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় যেন আগের সব রোলকে ছাপিয়ে গেল। জনতার চাপে সেদিন থিয়েটারের গেট বন্ধ করা যায়নি, কত লোককে যে ফিরে যেতে হল তার ঠিক নেই।
গুরমুখের সঙ্গে ভালবাসার খেলায় মেতেছেন বিনোদিনী। সে-ই এখন তার সুখদুঃখের সঙ্গী। এর মধ্যে একদিন বিনোদিনীর দখল নিতে উদয় হল তার পুরনো প্রেমিক।
সে বললে, ওই গুরমুখ হারামজাদার কাছে তুমি কেন গেলে? যদি টাকার জন্য হয় তো ও তোমাকে যা দিচ্ছে আমি তার চেয়ে আরও দশহাজার টাকা বেশি দেব।
শুনে বিনোদিনী জ্বলে উঠলেন, যখন আমাকে ছেড়ে গেলে তখন মনে ছিল না? রাখো তোমার টাকা। আমি অনেক টাকা রোজগার করেছি কিন্তু টাকা কোনও দিন আমাকে কিনতে পারে না। ওরকম দশ-বিশ হাজার আমার কত আসবে।
বিনোদিনীর কথায় রেগে উঠে সেই পুরনো প্রেমিকটি তলোয়ার খুলে তেড়ে এল তার দিকে। ঘরে লণ্ডভণ্ড বেঁধে গেল। তার প্রতি বিনোদিনীর যেটুকু প্রেম অবশিষ্ট ছিল, এই ঘটনায় তা প্রায় উবে গেল। তার হাত থেকে রক্ষা করতে বিনোদিনীকে নিয়ে কিছুদিন কলকাতার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালেন গুরমুখ। শহরে শুরু হল তাদের নিয়ে কেচ্ছার ফুলঝুরি।
.
কলকাতা ফেরার পর একদিন গুরমুখ বললেন, বিনোদ, বাড়ির লোকেদের চাপে আমার তো জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। এবার বোধহয় আর উপায় নেই, তোমাকে ছেড়ে বাড়ি ফিরতে আমার মন চায় না, কী যে করি?
বিনোদিনীর চোখ ছলছল করে। ভেজা গলায় অতলজলের মতো চোখদুটি তুলে তিনি বললেন, তোমার আবদারে আমি সব ছাড়লাম। প্রেমিক ছাড়লাম, জ্যোতিঠাকুরের মতো অমন মানীজনকে ফেরালাম, আর এখন তুমি আমাকে ভাসিয়ে চলে যাবে?
উনিশের গুরমুখের মুখে বাসনা ও বেদনার টানাপোড়েন যেন মেঘ ও রৌদ্রের মতো ছায়া ফেলে। মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের অত্যন্ত ধনী সন্তান, কিছুদিন যথেচ্ছাচার করার পরেই আত্মীয়রা পেছন থেকে রাশ টেনে ধরেছে। তাতেও তাকে বিনোদিনীর কক্ষচ্যুত করা যাচ্ছিল না, কিন্তু শেষমেষ মায়ের আত্মহত্যার হুমকিতে নড়ে গেছেন গুরমুখ।
যেতে চাই না কিন্তু মায়ের জন্য ফিরে যেতে হবেই বিনোদ। গুরমুখ তার কোলে মাথা গুঁজে বলেন, কিন্তু ভাসিয়ে যাব না, যাওয়ার আগে তোমার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব।