বিরক্ত বিনোদিনী হাত ছাড়িয়ে নেন, থিয়েটার ফিয়েটার কথাটা শুনে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। কিছুদিন ধরেই সদ্য গোঁফ গজানো এই যুবকটি তাকে টানাটানি করছে, কিন্তু বিনোদের মনে আগের প্রেমিকের প্রতি ভালবাসা ছিল, তাই পাত্তা দেননি।
গিরিশও বিরক্ত হন, তা হলে তুমি এখন এসো গুরমুখ, আমরা থিয়েটার নিয়ে একটু সিরিয়াস আলোচনা করছি।
জ্যোতি আর সহ্য করতে পারেন না, আঠারো-উনিশ বছরের ছেলের মাতাল হয়ে এ কী বেহায়াপনা! উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি নিজে থেকে যাবেন না গলা ধাক্কা দেব?
আরে, এ যে দেখি ঠাকুরবাড়ির জ্যোতিরিন্দ্র। অন্ধকারে চাঁদের উদয়! গুরমুখ জ্বালা ধরানো হাসি হাসেন, এনার কাছেই কি নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছিলে বিনোদ? এই তোমাদের সিরিয়াস আলোচনা?
বিনোদিনী নিজেকে স্পষ্ট করতে চান, গুরুমুখবাবু শুনুন, আপনি ভুল বুঝছেন। আমরা ন্যাশনাল ছেড়ে দিয়েছি। নতুন থিয়েটার গড়ব, তার জন্য টাকা চাই। কী করে টাকা জোগাড় হবে, আমরা তা নিয়েই মিটিং করছি। আমি জ্যোতিঠাকুরকে বলছিলাম, উনি যদি থিয়েটার গড়ে দিতে পারেন, আমি ওঁর কেনা হয়ে থাকব।
কত টাকা চাই বলো? গুরমুখের এবার বীরত্ব জেগে ওঠে, টাকা দিয়ে পৃথিবীতে যা-কিছু কেনা যায়, সবই তিনি কিনতে পারেন। উল্লসিত মুখে বলেন, বিনোদিনী, যত টাকা তোমাদের থিয়েটার তৈরি করতে লাগবে, আমি পুরো টাকাই ফেলে দেব।
জ্যোতির হৃদয়ে যেন শেল বেঁধে, অথচ তিনি অসহায়, গুরমুখের মতো করে বলার ক্ষমতা তার নেই।
দেবে তুমি? বিনোদিনীর গলায় এবার মধু ঝরে পড়ে, কিন্তু গুরমুখবাবু তুমি তো জানও না কত টাকা? আমাদের কিন্তু অনেক অনেক টাকা লাগবে।
তোমার জন্য যা লাগে তাই ঢালব সুন্দরী, গুরমুখ দম্ভভরে বলেন, আমি থিয়েটার ফিয়েটার জানি না, আমি তোমার শখের জন্য টাকা দেব।
এবার গিরিশ আসরে নামেন। গুরমুখ তুমি এমনি এমনি এত টাকা দেবে? থিয়েটারের শেয়ার চাও না? অবশ্য তুমি না চাইলেও আমরা দেব। একাজ যদি করতে পার, বাংলার থিয়েটারের ইতিহাসে তোমার নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে।
হাঃ, দুদিনের জীবন, কীসের শেয়ার! কে চায় অমরত্ব! গুরমুখ হা হা করে হেসে ওঠেন। আমি শুধু বিনোদিনীকে চাই।
জ্যোতি বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? এ কি মেছোবাজারের দরদাম চলছে? আপনি টাকা দিয়ে থিয়েটারকে বাঁচাচ্ছেন না বিনোদিনীকে কিনতে চাইছেন?
এতক্ষণে আমার মনের কথাটা বলে দিয়েছেন ঠাকুরবাবু, গুরমুখ লাফিয়ে ওঠেন, আমার কাছে রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই এক। এ হল রূপের হাটের বিকিকিনি।
ছিঃ বিনোদিনী, এ-সব তোমরা সহ্য করছ কী করে? লোকটাকে এখনও গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছ না কেন? জ্যোতি ধিক্কার দিয়ে ওঠেন।
গিরিশ তাকে বাধা দেন, আঃ জ্যোতিবাবু, ও যদি সত্যিই টাকা দেয় আর তাতে নতুন থিয়েটার তৈরি হয়, আমরা যে-কোনও শর্তে রাজি হব। আমাদের কথাবার্তা বলতে দাও, আগে উত্তেজনা ছড়িয়ো না।
কিন্তু এই লোকটা তো বিনোদিনীকে অপমান করছে, জ্যোতি তবুও ফুঁসে ওঠেন।
অপমান কীসের, গুরমুখ অবাক হয়ে বলেন, আমি তো বিনোদিনীর জন্যেই সবকিছু করব, আমি ওর নামেই থিয়েটারের নাম দেব। কী বিনোদ, আমাকে একটু ভালবাসবে তো?
বিনোদিনীর অনেক জ্বালাযন্ত্রণার ওপর এই কথায় যেন মলম পড়ে, তিনি মধুর হেসে গুরমুখের দিকে এগিয়ে বলেন, সত্যি বলছ, আমার নামে থিয়েটার হবে? এ-কথা তো আগে কেউ আমাকে বলেনি!
জ্যোতিকে শান্ত করতে তার হাতে হাত রাখেন, দেখুন জ্যোতিঠাকুর, উনি এত ভাল একটা প্রস্তাব দিচ্ছেন, আপনি আর রাগ করবেন না, আমার এত সহজে অপমান গায়ে লাগে না।
গিরিশ অবশ্য এই প্রস্তাবে খুশি হতে পারলেন না, তার সাধের থিয়েটার হবে কিনা শেষে বিনোদিনীর নামে! লোকে যে ছ্যা ছ্যা করবে। বারাঙ্গনাকে দিয়ে নাটকে পার্ট করানো যায়, তাই বলে তার নামে থিয়েটার!
তিনি কায়দা করে বললেন, থিয়েটারের নাম নিয়ে পরে ভাবা যাবে, আগে হোক তো। গুরমুখবাবু যদি এই থিয়েটারে টাকা দেন, বিনোদিনীর জন্যই দেবেন, কিন্তু যে-কোনও বিনোদিনীর চেয়ে থিয়েটার যে অনেক বড়, এটা কোনও দিন ভুলিস না বিনোদ।
না, না, গিরিশবাবু, আমি বিনোদিনীর নামেই থিয়েটার করব, ওর নামে শেয়ার লিখে দেবেন, গুরমুখ বলে ওঠেন, আমি নিজে শেয়ার চাই না, শুধু বিনোদিনীকে নিজের করে পেতে চাই।
অমৃতলাল বলেন, আপনার প্রস্তাব তো ভালই, কিন্তু জীবিত নট-নটীদের নামে তো থিয়েটার হয় না, তা ছাড়া বিনোদের নামে নাম দিলে লোকে আসবে না, সমাজের মাথারা বয়কট করবেন। কাজ কী অত ঝামেলায়, আমরা তো জানলাম আপনি বিনোদিনীকে দিলেন।
গুরমুখ বিনোদিনীর মতামত চান, কী গো সুন্দরী, আমি তো পঞ্চাশ হাজার টাকা এখনি তোমাকে ঢেলে দিতে পারি, তুমি ঠিক করো টাকা নিজে নেবে না এদের কথা শুনে সবটা থিয়েটারে ঢালবে?
না, না, গুরমুখবাবু, বিনোদিনী বললেন, আমার টাকার লোেভ নেই। আপনি থিয়েটারের জন্যই টাকা দিন, গিরিশবাবু আমার নামে থিয়েটারের অংশীদারিত্ব লিখে দিলেই আমি খুশি হব।
বাবা, এ মেয়ে যে চমকে দিল, গুরমুখ হেসে ওঠেন, টাকাপয়সা চায় না, শুধু থিয়েটার করতে চায়, তার জন্য এত স্যাক্রিফাইস? কী জ্যোতিঠাকুর, এমন নটী আর দেখেছেন?