জ্ঞানদা তীক্ষ্মচোখে জ্যোতিকে দেখেন, চিবুক ধরে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলেন, একটা সত্যি কথা বলবে নতুনঠাকুরপো, কাদম্বরীর সন্দেহ কি সত্যি? তুমি কি সত্যি বিনোদিনীর প্রেমে পড়েছ?
জ্যোতি জ্ঞানদার সামনে থেকে সরে যান জানলার কাছে, কী করে বোঝাব মেজোবউঠান, কখনও কখনও নাট্যকারের কাছে নায়িকা তার লেখার প্রেরণা হয়ে ওঠে তুমি কি জান না তা? প্রেরণাকে প্রেম নাম দিলে বড্ড স্কুল শোনায়, জিনিসটাকে এত নীচে নামিয়ে এনো না, দোহাই তোমাদের।
জ্ঞানদার ভয় হয় জ্যোতি বোধহয় ভাবছেন তিনিও কাদম্বরীর মতো মোটাদাগের চিন্তায় নামিয়ে আনছেন বিনোদিনীকে। কিন্তু তিনি তো কাদম্বরী নন, তাড়াতাড়ি বলেন, না নতুনঠাকুরপো, সে ভয় কোরো না, বিনোদিনী যদি তোমার প্রেরণা হয়, আমি কখনও তাকে মোটা দাগে বিচার করব না। আটকেও রাখব না। যাও তুমি তোমার মিউজের কাছে।
বিনোদিনীর বাড়ি পৌঁছে জ্যোতি দেখলেন পরিবেশ থমথমে। বিনোদিনীর মুখে সংকটের ছায়া। গিরিশ মাথার চুল ছিঁড়ছেন। অমৃতলাল চুপচাপ বসে আছেন।
বিনোদিনীর এক ধনী প্রেমিক ছিল, সম্প্রতি সে লুকিয়ে বিয়ে করেছে। সেজন্য বিনোদিনীর খুবই মন খারাপ, জ্যোতি জানেন। কিন্তু সেজন্য সবাই এত গম্ভীর থাকবেন তা তো সম্ভব নয়। তবে কী হল?
জ্যোতি সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, কী হয়েছে বিনোদিনী? কারও অসুখ করেছে?
না জ্যোতিবাবু, ভেজা গলায় বিনোদিনী বলেন, আমার স্বপ্ন বুঝি অধরা থেকে গেল। আমি ন্যাশনাল থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়েছি। গিরিশবাবু এখন একটি নতুন থিয়েটার তৈরি করতে চান, কিন্তু টাকার অভাবে সে-চেষ্টা থমকে যাচ্ছে।
গিরিশবাবু ন্যাশনাল ছেড়ে নতুন থিয়েটার করবেন, জ্যোতি উল্লসিত হন, এ তো দারুণ খবর।
গিরিশ বলেন, ওহে ঠাকুরবাবু, ন্যাশনাল থিয়েটারে তো আর ভদ্রলোকে থাকতে পারছে না। মালিক কথায় কথায় সবাইকে অপমান করছেন। বিনোদিনী পনেরো দিন বেনারস বেড়াতে গেছিল বলে ওর টাকা কেটেছে। বিনোদ তাই রাগ করে ন্যাশনাল ছেড়ে দিল। আমিও বেরিয়ে এসে নাটক করছি। এখন নতুন থিয়েটার তৈরি করতে চাই। আপনার তো অনেক টাকাপয়সা, প্রতিপত্তি। দেখুন না কিছু করতে পারেন কি না।
জ্যোতি উদগ্রীব হয়ে জানতে চান, কী করতে হবে বলুন। বিনোদিনীর চোখের জল মোছর জন্য তিনি সবকিছুই করতে পারেন।
টাকা চাই, অনেক টাকা, গিরিশ বলেন, পারবেন কিছু করতে? আমার তো শখের থিয়েটার না, এ থেকেই রুটিরুজি চালাতে হবে।
জ্যোতি নিজেকে ধিক্কার দেন মনে মনে। অনেক টাকা তিনি কোথা থেকে দেবেন, কিছু জোগাড় করা যেতে পারে মাত্র। বাবামশায় তো কখনওই থিয়েটারের পেছনে এত টাকা ওড়াতে দেবেন না, তার নিজের অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়। তবু বিনোদিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে বলে ফেলেন, কিছু তো দিতেই পারি, আরও কিছু জোগাড় করা যায়। হাল ছেড়ে বসে থাকলে তো হবে না।
বিনোদিনী এগিয়ে এসে জ্যোতির হাত ধরে বলেন, সত্যি কিছু করা যাবে? আমাদের নতুন থিয়েটার গড়ে দিলে আমি চিরদিন আপনার কেনা হয়ে থাকব জ্যোতিঠাকুর।
জ্যোতির গা ভাললাগায় শিরশির করে ওঠে। এতদিন ওই প্রেমিকের জন্য বিনোদিনী তাকে কাছে ঘেঁসতে দেয়নি, আজ এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তটা যদি চিরস্থায়ী করে রাখা যেত!
কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢোকেন এক অল্পবয়সি যুবক, দামি বিলিতি মদের গন্ধে তাঁর গা ভুরভুর করছে, অঙ্গে মহামূল্য আঙরাখা, গলায় লম্বা সোনার চেন, পাঁচ আঙুলে হিরে-পান্নার আংটি। ঢুকতে ঢুকতেই আগের কথার রেশ টেনে বলেন, কী বিনোদিনী, আমাকে ফেলে অন্য কোনও মহাপুরুষের কেনা হয়ে থাকবে তুমি?
বিনোদিনী তাঁকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যান, তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে বলেন, গুরমুখবাবু আপনি বসুন, ওরকম টালমাটাল করবেন না।
গিরিশ গুরমুখকে আপ্যায়ন করতে চান, বড়লোকের ছেলে, সাহায্যে লাগতে পারে। বলেন, আহা বিনোদ, ওঁকে ওরকম করে বোলো না, উনি থিয়েটার ভালবাসেন, ওঁকে একটু আদরযত্ন করো।
গিরিশ নিজেও আর ন্যাশনালে থাকতে চান না। মালিক প্রতাপাদ এতদিন শিল্পীদের অবহেলা করলেও তার কথা শুনতেন। ক্ষুব্ধ শিল্পীরা গিরিশের কথায় মালিকের অন্যায় মেনে নিয়েও কাজ করছিল। কিন্তু ইদানীং প্রতাপ যেন গিরিশকেও গুরুত্ব দিতে চান না, ন্যাশনালের বাণিজ্যিক রমরমা যে গিরিশ আর বিনোদিনীর জন্যেই, তা আর মানতে চাইছেন না তিনি। এই অবস্থায় গিরিশ চাইছেন নতুন করে শুরু করতে। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল ছেড়ে ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি নামে একটা নাট্যদল গড়েছেন তিনি। অমৃতলাল মিত্র, নীলমাধব চক্রবর্তী, অঘোরনাথ পাঠক, বিনোদিনী, ক্ষেত্ৰমণি, কাদম্বিনী, গঙ্গামণিরাও যোগ দিয়েছেন নতুন এই দলে। পুরনো সীতাহরণ নাটকটি নতুন দলের ব্যানারে অভিনয় শুরু হয়েছে, তবে নির্দিষ্ট কোনও স্টেজ না থাকায় আজ এখানে কাল ওখানে হচ্ছে। এভাবে বেশিদিন চলবে না, তাই গিরিশ মরিয়া হয়ে উঠেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ থিয়েটার মঞ্চ গড়তে, আর তার জন্য বড়লোক বাবু ধরা দরকার। বিনোদিনীকে সুকৌশলে টোপ হিসেবে এগিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
বিনোদিনী কাছে গেলে গুরমুখ বলেন, না না, গিরিশবাবু, একটু ভুল বললেন, আমি থিয়েটার ফিয়েটার ভালবাসি না, ভালবাসি শুধু বিনোদিনীকে। তার হাত ধরে টেনে ডাকেন, এসো বিনোদ, আমার বুকে এসো।