তা ছাড়া ঠাকুরবাড়িতে একমাত্র এই কাদম্বরীর কাছেই তাকে কয়েকবার হার মানতে হয়েছে। তার সামনেই নতুনবউকে নিয়ে ছাদের আসরে জ্যোতি, রবি, অক্ষয়, বিহারীলালদের আদিখ্যেতা তিনি ভুলে যাননি।
এখন জ্যোতির যে ঘরে মন টেকে না, তাতে তিনি আশ্চর্য নন মোটেই। জ্যোতির মতো সৃষ্টিশীল প্রতিভা চিরদিন ওই বউকে নিয়ে মেতে থাকতে পারবে না, এ বিশ্বাস তার ছিলই। তার ওপর এখন কাদম্বরী যেরকম ঘ্যানঘ্যানে হয়ে গেছে, জ্যোতি আর কত সইবে?
গানবাজনার শেষে জ্যোতির মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, মেজোবউঠানের কাছে রাতে থেকে যান। জ্ঞানদাও তাকে নিজের কাছে টেনে নেন স্নেহে, শুশ্রূষায়, ভালবাসায়। এই দেবরটির প্রতি তার অদ্ভুত টান এখনও অটুট।
সদর স্ট্রিটের বাড়িটা দামি দামি ফার্নিচার কিনে সাজিয়ে তুলেছেন জ্যোতি, তাতে আবার লেগেছে কাদম্বরীর রুচির ছোঁয়া। তবু সেই বাড়িটাকে মাঝে মাঝে একঘেয়ে মনে হয় জ্যোতির। গান কবিতা সাজসজ্জার আড়ম্বরের মধ্যেও পুরনো দাম্পত্য যেন হাঁপিয়ে ওঠে নতুন প্রাণের অভাবে।
জ্ঞানদার বাড়ির উদার স্নেহময় বাতাসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যায়। শুধু মেজোবউঠান নন, তার ছেলেমেয়েরাও জ্যোতিকে স্নেহের বন্ধনে আটকে রাখে। আহা কাদম্বরীর কোলে যদি একটি কচি উপহার দিতে পারতেন। জ্যোতি নিজেকেই দোষ দেন। হতাশায় বাড়ি ফেরেন না, রবি সতর্ক করেন, জ্যোতিদাদা, নতুনবউঠান কিন্তু রাগ করবেন, সে আমি সামলাতে পারব না।
জ্যোতি রবিকে বলেন, সে আমি কাল গিয়ে সামলে নেব। তুই সদর স্ট্রিটে ফিরে আজ রাতে বউঠানকে পাহারা দে রবি।
কেন একদিন একা থাকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে তার? জ্ঞানদা ডাইনিং টেবল সাজাতে সাজাতে বলেন, আমি গাড়োয়ানকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, রবি তুমিও আজ থেকে যাও।
বিবি এসে রবির হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে, যেয়ো না রবিকা, আজ আমরা সেই বিলেতের মতো গান করব সবাই মিলে।
বালিকা বিবির স্নেহকাঙাল মুখের দিকে তাকিয়ে টানাপোড়েনে পড়ে যান রবি, তবু সেই নিঃসঙ্গ অভিমানিনী নতুনবউঠানের মুখ মনে করে শেষে সদর স্ট্রিটের দিকেই পা বাড়ালেন।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জ্যোতির মনে পড়ল বিনোদিনীর মুখ। এই সকালে তার মানসীপ্রতিমার ধ্যানে কাদম্বরী ঢুকে পড়তে পারছেন না বলেই জ্যোতির ঘুম পাড়িয়ে রাখা প্রেম চনমন করে উঠল। তিনি ঠিক করে ফেললেন, অনেকদিন যাওয়া হয়নি, আজ বিনোদিনীর খোঁজ নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবেন।
বিলিতি কায়দায় জ্ঞানদার ব্রেকফাস্ট ঘন্টি বেজে উঠল, অর্থাৎ টেবলে খাবার রেডি। এমনিতে বিলেতের সব চালচলন মানতে পারেন না জ্ঞানদা, কিন্তু যেগুলি ভাল তা তিনি গ্রহণ করেছেন। ওদের গুছিয়ে সংসার করার কায়দাকানুনগুলি বেশ ভাল, এই যেমন টেবিলে বসে একসঙ্গে খানাপিনার ব্যাপারটা। বাঙালি বাড়িতে কর্তার খাবার আগে সাজিয়ে দিতে হবে তাঁর সময়মতো, ছেলেপুলেরা আলাদা আলাদা সময়ে খাবে, গিন্নিরা খাবেন সবার হয়ে গেলে তারপর। এতে সময় অনেক নষ্ট হয় আর গৃহিণীর পরিশ্রমও বেশি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়ার পাট চুকে গেলে টেবিল পরিষ্কার করে গিন্নিরাও পড়াশোনা বা পছন্দসই অন্য কাজে মন দিতে পারেন।
সবচেয়ে বড় কথা, সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। নিজেদের কথাবার্তা হাসিঠাট্টার মধ্যে যে খোলামেলা মেলামেশা হয়, সেটাই পারিবারিক সম্পর্কের আসল অমৃতধারা।
জ্যোতি টেবিলে পৌঁছে দেখলেন, বিবি সুরেন জ্ঞানদারা সবাই আগেই এসে গেছেন। কিন্তু কেউ খাওয়া শুরু করেনি, তার জন্য অপেক্ষা করছে। জলখাবারের মেনু অবশ্য বিশুদ্ধ মতে, গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত মাছের কচুরি দেখে জ্যোতি বুঝতে পারেন জমিয়ে খিদে পেয়েছে। সেই সঙ্গে আবার হাতছানি দিচ্ছে বরফকুচি দেওয়া ফলের রস আর চিনেমাটির বাটিতে সাজানো কাজু-কিশমিশ দেওয়া মোহনভোগ।
জ্ঞানদা জানতে চান, এখনি বাড়ি ফিরবে নাকি জ্যোতি? এসেছ, দু তিনদিন থেকে একটু জিরিয়ে যাও না।
জ্যোতি হেসে উড়িয়ে দেন, কী যে বলো মেজোবউঠান, আমি তো প্রায় রোজই আসি। দিনের বেলা কি আমার কোনও কাজকর্ম নেই?
তা হলে কাজ সেরে ফিরে এসো, দুপুরে ইলিশ রান্না হবে। জ্ঞানদা যেন বালক দেওরকে লোভ দেখান।
জ্যোতি হেসে বলেন, আর আমার বউ যে গোঁসাঘরে খিল দেবে, তোমার তাতে খুব মজা হবে, না? কেন যে তোমার এখনও এত রাগ সে বেচারার ওপর!
আমার রাগ করতে বয়ে গেছে, জ্ঞানদা ফোঁস করে ওঠেন, সে কি আমার ঘরের লোক যে রাগ করব?
আর আমি? জ্যোতি জানতে চান, আমাকে যে আটকে রাখতে চাও তোমার কারাগারে, সে কোন অপরাধে দেবী?
আহা, জ্ঞানদা অভিমানী গলায় বলেন, জানো না যেন, তোমাকে ভালবাসি বলেই ধরে রাখতে চাই। তোমার মেজদাদা কোন সুদূরে পড়ে থাকেন, আমার কি ভাল লাগে একা একা শুধু বিবি-সুরেনকে নিয়ে সংসার সামলাতে! তুমি থাকলে আমাদের বাড়িতে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। বিবি সুরেনরাও কত খুশি হয়, তুমি বোঝো না!
কালপরশুই আবার আসব বউঠান, জ্যোতি জ্ঞানদার হাতের ওপরে হাত রেখে মিনতি করেন, আজ ছুটি দাও।
কোন রাজ্যজয় করতে যাবে শুনি? জ্ঞানদা কৌতূহলী হন, এখনি বাড়ি যাবে না নিশ্চয়ই!
বিনোদিনীর সঙ্গে দেখা করতে হবে একটু, জ্যোতি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলেন, আমার পরের নাটকে ওকে নায়িকা করতে চাই।