ব্রাহ্ম বিয়ে হলেও সপ্তপদীতে কোনও বাধা দেননি মহর্ষি। বরণডালা সাজিয়ে বরণ করার অনুষ্ঠান ও ব্রহ্মোপাসনা সেরে বাসরঘরে ঢুকলেন বরবউ। কিন্তু অব্রাহ্ম নারীপুরুষেরা কেউ বিয়েতে যোগ দেননি। হেমেন্দ্র গম্ভীর প্রকৃতির যুবক কিন্তু রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বেনারসি জোড়ের সঙ্গে নানা অলংকার পরে তাঁকে যেন দেবরাজ ইন্দ্রের মতো লাগছিল। ছোটবোন প্রফুল্লময়ী অবশ্য দিদির বরকে সাক্ষাৎ শিব ভেবে বসেছিলেন। পরে অন্য বালিকারা তাঁকে বোঝাল, শিব তো সর্বত্যাগী, তিনি কেন হিরের কণ্ঠি, মুক্তোর মালা, পান্নার আংটি পরবেন? ঠাকুরবাড়ি থেকে আসা এই জামাইবাবু আসলে ছদ্মবেশী ইন্দ্র। দিদির রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করতে এসেছেন।
বাসরে পাছে মেয়েদের হালকা ঠাট্টার সামনে পড়তে হয় সেই ভয়ে হেমেন আগে থেকেই একটা উপায় ভেবে রেখেছিলেন। ঘরোয়া মেয়েদের চটুল ঠাট্টাইয়ার্কির ওষুধ হিসেবে তিনি স্ত্রীশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা শুধু বাংলাই পড়ে না, অনেকেই সংস্কৃত ও ইংরেজি পড়তে পারে শুনে উপস্থিত কমশিক্ষিত ব্রাহ্মিকারাও অবাক।
হেমেন লজ্জায় জড়সড় কনে নীপময়ীকে বললেন, তোমাকেও শিখতে হবে। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত সাহিত্য।
নীপময়ী সেদিন লজ্জায় উত্তর দেননি। সকলের সামনে নববিবাহিত স্বামীর সঙ্গে কথা বলা যায় নাকি! তবে এ স্বামী তাঁর দেখা অন্যান্য বরেদের মতো নয়, প্রথম থেকেই আলাদা। বাসরের মেয়েদের অনুরোধে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে নীপময়ীকে হেমেন বললেন, তোমার গলায় যদি সুর থাকে, বাবামশায়ের অনুমতি নিয়ে গানও শেখাব।
এবার সত্যি শিউরে ওঠেন মেয়েরা। পাগল নাকি এ ছেলে? বলে কী, ঘরের বউ গান গাইবে? তা হলে বউ আর বাইজিতে তফাত থাকবে কী করে?
ক্রমশ কিন্তু হেমেন তার কথা কাজে পরিণত করছেন। নীপময়ী ও অন্তঃপুরের অন্য মেয়ে-বউদের নিয়ে জোড়াসাঁকোর অন্দরে তিনি নিজেই শুরু করেছেন ঘরোয়া পাঠশালা। সেখানে সৌদামিনী, শরৎকুমারী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারী সবাই নিয়মিত ছাত্রী। হেমেনের কড়া শাসনে তাদের পড়া এগোচ্ছে তরতরিয়ে।
নীপময়ীকে গান শেখানোর অসম্ভবকেও তিনি সম্ভব করেছেন। বাবামশায় প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে সম্মতি দিয়েছেন। বহু সমালোচনা উপেক্ষা করে বাড়ির গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তীকে নীপময়ীর গানের শিক্ষক নিয়োগ করলেন দুর্জয় সত্যেন্দ্রনাথের দুঃসাহসী ভাই হেমেন্দ্রনাথ। সেই কবে ঘরের মেয়েদের গলা থেকে গান কেড়ে নিয়েছিলেন অওরংজেব, এতদিন পরে সেই গানকেই যেন নীপময়ীর কণ্ঠে ফিরিয়ে আনলেন হেমেন।
ঠাকুরবাড়িতে জন্ম এবং বিবাহ অবশ্য লেগেই থাকে। এই সেদিন ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে দেবেন্দ্রের প্রিয়কন্যা স্বর্ণকুমারীর। সুদর্শন, সমাজ-সংস্কারক জানকীনাথকে কৃষ্ণনগর থেকে খুঁজে এনেছেন দেবেন্দ্র। ঠাকুরদের সঙ্গে কেউ ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চায় না, তাই ভাল ছেলে দেখলেই কন্যাদের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাদের আপন করতে চান তিনি। এই বিয়ের জন্য জানকীনাথ পিতা জয়চন্দ্র ঘোষালের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত ও ত্যাজ্যপুত্র হলেন। কিন্তু বাবামশায়ের ক্রোধ উপেক্ষা করেও ঠাকুরবাড়ির আলোর হাতছানিতে সুন্দরী, বিদুষী স্বর্ণকুমারীর আকর্ষণে বাঁধা পড়লেন জানকীনাথ।
স্বর্ণর বিয়ে হল তেরো বছর বয়সে। সে তুলনায় ঠাকুরবাড়ির বউরা সবাই অনেক কমবয়সে এসেছে। বিয়ের আগে মাকে জড়িয়ে ধরে স্বর্ণ জানতে চেয়েছিলেন সারদার বিয়ের গল্প।
নিজের বিয়ের প্রায় ভুলে যাওয়া বেত্তান্ত মনে করে সারদা বলেন, আমি ছিলাম যশোরের পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। আমার এক কাকা কলকেতা থেকে শুনে গেলেন কত্তার জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। ব্যস ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে।
সে কী গো? তার মানে আমাদের বাড়ির বউ-মেয়েরা কেউ তোমাকে দেখতে যায়নি? স্বর্ণ অবাক হন। ঠাকুরদের চিরদিনের রীতি ছিল প্রথমে দাসী পুতুল নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবে, পছন্দ হলে সুযোগসুবিধে মতো যাবে। বাড়ির মেয়েরা।
শোন, আমার কাকার বোধহয় ভয় ছিল পাত্র হাতছাড়া হয়ে যাবে। তিনি বাড়িতে ঢুকেই দেখলেন আমি দাওয়ায় বসে রান্নাবাটি খেলছি। টেনে তুলে কোনওরকমে একটা পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে তৎক্ষণাৎ নিয়ে চললেন কলকেতায়। আমার মা তখন নদীতে নাইতে গেছিলেন। আমার মাত্র ছবছর বয়স। কেঁদেকেটে বললাম, মা আসুক তবে যাব। কাকা কোনও কিছু না শুনে আমাকে নিয়ে এলেন। মায়ের সঙ্গে শেষ দেখাটাও হল না। শুনেছি মা আমার ফিরে এসে মেয়ের শোকে উঠোনের গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই মরে গেলেন। এই তো আমাদের কালের মেয়েদের জীবন। তোরা অনেক ভাগ্য করে এই বাটিতে জন্মেছিস মা, অমন দেবতার মতো বাবামশায় পেয়েছিস, তাই লেখাপড়া শিখলি, বাইরের হাওয়াবাতাস গায়ে মাখতে পারলি।
এখনও সারদা ভাবছিলেন, কত্তা অমন দেবতার মতো মানুষ বলেই ওঁর ধর্ম মানি আবার আমারটাও। মেয়ে-বউরা কি তা বোঝে না!
বর্ণকুমারী বালিকা, বেশি কিছু না বুঝেই সে বলে ওঠে, মা তুমি তো সেদিন মেজোকাকির কাছে লক্ষ্মীজনার্দনের জন্য পুজো দিয়ে পাঠালে। আমিই তো নিয়ে গেলাম মা, বাবামশায় কি তাতে রাগ করবেন?