শরৎকুমারীর সবে বিয়ে হয়েছে, স্বামীসহ এখানেই থাকছেন। ইতিমধ্যেই রাঁধুনি হিসেবে তাঁর খুব নাম হয়েছে। তিনি আহ্লাদ করে বলেন, মা একটা নতুন সুপ রান্না শিখেছি, ডিম দিয়ে মুলিগাতানি সুপ। আজ বাবামশায়ের জন্য সেই সুপ করে দেব ভাবছি।
দেখ বাছা, সারদা বলেন, কত্তাকে এই দু-চারদিনে কিছু ভালমন্দ খাইয়ে খুশি করতে পার কিনা। ও সুপ কোত্থেকে শিখলি?
সেই যে সেদিন ও বাড়ির মেজোকাকিমা, রেসিপি লিখে পাঠিয়েছেন, উনিই কোথা থেকে শিখে এসেছেন। সত্যি মা, মেজোকাকিরা চলে গিয়ে বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগে।
সারদাও বিমর্ষ গলায় বলেন, হ্যাঁ রে ওদের কথা ভাবলে কষ্ট হয়। এক বাড়িতে হেসে-খেলে একসঙ্গে কাটিয়েছি, ছোটবেলায় শ্বশুরবাড়ি এসে ওই তো সঙ্গী ছিল আমার। ধম্মো ধম্মে করে কী গোল শুরু করলেন কত্তা, লক্ষ্মীজনার্দনকে বিদেয় করতে চাইলেন বলেই তো এত গোল বাধল! আর এতদিনের অধিষ্ঠিত দেবতাকে উঠিয়ে নিয়ে ওরা ও-বাড়ি চলে গেল।
আগে যেটা ছিল দ্বারকানাথের সন্ততিদের একান্নবর্তী বসতবাড়ি, সেখানেই দেওয়াল উঠল। ৫ নং আর ৬ নং বাড়ি আলাদা হয়ে গেল। বাগান ভাগ হল, পুকুরের ঘাট আলাদা হল। দ্বারকানাথের সময় থেকেই ঠাকুরপরিবারে ব্রাহ্মধর্মের আনাগোনা শুরু হয়েছিল। রামমোহন বিলেত গেলে দ্বারকানাথের অর্থসাহায্যেই ব্রাহ্মসমাজের কাজকর্ম চলছিল। ইতিমধ্যে লন্ডনে বিপুল সমাদর পেয়ে দ্বারকানাথ ক্রমশ কলকাতার জীবনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং বিলেতে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। দেবেন তখন থেকে ব্রাহ্মসমাজের ভার। নিলেন। ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ ভাই গিরীন ও আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেবেন্দ্র ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন। কিন্তু দেবেন যতটা ধর্ম ধর্ম করে মেতে উঠলেন গিরীন্দ্রনাথ কোনওদিনই ততটা জড়িয়ে পড়েননি। বাড়ির হিদুয়ানির ধারা তখনও পুরোমাত্রায় চালু ছিল। প্রথম ধর্মসংকট বাধল লন্ডন থেকে দ্বারকানাথের মৃত্যুসংবাদ এলে। দেবেন ব্রাহ্মমতে বাবামশায়ের শেষসংস্কার করলেন, শালগ্রাম শিলা এনে পৌত্তলিকতার চর্চা করতে তার মন সায় দিল না। তাই নিয়ে সমাজে দারুণ শোরগোল শুরু হল, আত্মীয়স্বজন এবং হিন্দুসমাজের মাথারা অনেকেই দেবেনবাবুকে সামাজিকভাবে বর্জন করলেন। গিরীন্দ্রনাথ অবশ্য ব্রাহ্ম হয়েও হিন্দুশাস্ত্রমতে শ্রাদ্ধ না করে পারেননি। অন্দরে তার স্ত্রী যোগমায়া কিছুতেই স্বামীকে অধর্ম করতে দেবেন না, তেজস্বিনী পত্নীকে অগ্রাহ্য করার সাহস গিরীন্দ্রর ছিল না।
কুটনো বানানো তদারকি করতে করতে সারদা একটু মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, তবে মেয়েমানুষের যোগমায়ার মতো অত তেজ বাপু ভাল না। গৃহদেবতাকে উঠিয়ে দেওয়ার কথা শুনে আমিও তো ভয়ে মরছিলাম, তা বলে কি ঘর ভেঙে আলাদা হয়ে যাবি?
বড়মেয়ে সৌদামিনী জানতে চান, মেজোকাকি তো চলে গেলেন, তুমিও মনে মনে বাবামশায়ের মতো বেম্ম হয়ে গেলে নাকি মা?
সারদা ঈষৎ বিব্রত হন। তোর বোন সুকুমারীর বিয়ে নিয়েই তো কী কাণ্ড! কত্তা জেদ ধরে বেম্মো-বিয়ে দিলেন। অগ্নিসংস্কার হল না, শালগ্রামসাক্ষী হল না। সেই তো শেষে অকালে মরে গেল মেয়েটা!
সে নিয়ে আমরা সকলেই দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু মা ব্রাহ্ম-বিয়ের দোষ দিচ্ছেন কেন? ব্রাহ্মমন্ত্রে বিয়ে হলেও অগ্নি-নারায়ণ সাক্ষী ছাড়া আর সব হিদুপাৰ্বণ তো হয়েছিল মা, সেজোবউ নীপময়ী বলে ওঠেন। এদিক ওদিক দুই ছিল। সুকু মারা গেল বাচ্চা হতে গিয়ে, অমন তো কত হয়, আপনি মনে খুঁতখুঁত করবেন না মা।
আমার জ্বালা তোরা বুঝবি না সেজোবউ, সারদা বিরক্ত হন। দেখ, আমার তো উভয়সংকট। তোদের বাবামশায় কত পড়াশোনা করা মান্যিগন্যি লোক, তিনি যা বলছেন তা তো খারাপ হতে পারে না। আবার ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ির কাছে যে পূজাপাঠ শিখেছি সে শিক্ষেও তো ফেলে দিতে পারি না। কী যে করি! আমার হয়েছে যত মরণ।
ঈষৎ বাঁকা চোখে নীপময়ীকে দেখেন সারদা, আর সেজোবউ, তুই এত কথা বলছিস, তোর বিয়েতে যে হাঙ্গামা হয়েছিল তা তো আমি জন্মে দেখিনি। বিয়ের রাতে আমার ছেলেকে মারতে গোঁড়া হিন্দুরা লেঠেল পাঠিয়েছিল। শেষে পুলিশ ডেকে এনে বে দিতে হল। কত্তা আর বেয়াইমশায় দুজনের জেদ ছিল বলেই অত বাধাবিপত্তির মধ্যেই তোদের বে হল। কিংবা আমার ঠাকুরপূজার জোরে, সে-কথা বললে কত্তা যতই রাগ করুন!
প্রিয় বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের দুই মেয়ে নীপময়ী আর প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে হেমেন্দ্র আর বীরেন্দ্রর বিয়ে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু কুলীন ব্রাহ্মণ হরদেব যখন ব্রাহ্মমতে পিরালি বামুনের ঘরে মেয়ের বিয়ে দেবেন ঠিক করলেন, জ্ঞাতিরা খেপে লাল। উঠেপড়ে তারা লাগল বিয়ে বন্ধ করতে, হলে যে তারাও জাতিচ্যুত হবে। এমনকী তাদের চাপে হরদেবের বড় ছেলে পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। তবু তার সংকল্প ভাঙল না, দেবেনের মতো জ্ঞানী, সচ্চরিত্র, সমৃদ্ধ বন্ধুকে কথা দিয়ে আত্মীয়দের অন্যায় আবদারে তিনি পিছিয়ে আসতে পারেন না। বড়ছেলে তার পাশে না দাঁড়ালেও তিনি আদর্শত্যাগ করবেন না। বিরোধীপক্ষ জোট বেধে বিয়ে আটকানোর ফন্দি করতে লাগল। নীপময়ীর জন্য এক বুড়ো কুলীন পাত্রও বেছে রাখল তারা। ঠিক হল যে বিয়ের রাতে একশো লেঠেল পাঠিয়ে বর হেমেন্দ্রের মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে কনে নীপময়ীকে তুলে আনা হবে, বিয়ে দেওয়া হবে ওই বুড়ো বরের সঙ্গেই। জানতে পেরে দেবেন্দ্রনাথ পুলিশে খবর পাঠালেন, তাদের পাহারাদারিতে বিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল।