সেদিনের সেই লজ্জাবতী ভীরু বালিকার মধ্যে এখন সত্যেন উদিত সূর্যের মতো এক নতুন নারীকে আবিষ্কার করেন। প্রবল আশ্লেষে ষোড়শী পত্নী জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করেন তিনি।
আঃ, ছাড়ো না, তুমি কি ছেলেমানুষ হয়ে গেলে? জানলা দরোজা সব খোলা, এখনই যে কেউ এসে পড়বে, জ্ঞানদা লজ্জা পান।
সত্যেন বলেন, কী বলেছিলাম মনে নেই বউ?
কত কী বলেছ, কোন কথাটা বলছ কী করে বুঝব এখন? জ্ঞানদা কটাক্ষ করেন।
সেই যে বিলেত থেকে চিঠিতে লিখেছিলাম, তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না।
জ্ঞানদার মনে পড়ে, সেই রাতের পর রাত জোড়াসাঁকো বাড়ির ছাতে নিরালা জ্যোৎস্নায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তিনি স্বামীর এইসব কথার মানে খুঁজেছেন। বালিকার মনে অজানা ভয়, স্বামী কেন তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করছেন না! কেন শুধু ওপর ওপর আদর করে দূরে সরে যান? কেন লেখেন, আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই। আমাদের পিতামাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন। তবে কি এখন সেই পরমলগ্ন এসেছে?
জ্ঞানদা নববধূর মতো রাঙা হয়ে ওঠেন। বলেন, সে-কথা এখন কেন?
বউ, এখনই তো সময় সে-কথা বলার। সত্যেনের গলা আবেগে কেঁপে ওঠে, এই সেই দাম্পত্যের নির্জন ঘর, এই সেই পুরাতন প্রণয়প্রার্থী, এই সেই স্থগিত ফুলশয্যার পালঙ্ক। আজ আর তুমি নিছক গৃহবধূ নও। হে স্বাধীনা, আজ আমি মিলনপ্রার্থী, আমার আবেদন কি মঞ্জুর করবেন দেবী?
এই অভাবিত মুহূর্তে কী করবেন ভেবে না পেয়ে জ্ঞানদা সত্যেনের বুকে ঢলে পড়ে বলেন, যাও আর নাটক করতে হবে না।
সত্যেন তীব্র কামনায় তার কোমর জড়িয়ে ধরেন। লজ্জানত মুখ তুলে ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন করেন। বহু প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্তে দুজনের থরোথরো শরীর তীব্র আবেগে দলিত মথিত ঘর্ষিত হতে থাকে। গরম বোধ করায় সত্যেন গায়ের ফতুয়া খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে দেন। জ্ঞানদার শাড়ি ধুলোয় লুটোয়। সত্যেনের অধীর আঙুলগুলি যেন নীড় খুঁজে পায় সেমিজ ঢাকা জ্ঞানদার উদ্ভিন্ন স্তনে। তখন দুজনের শরীরের মাঝখানে একটি সুতোর ব্যবধানও যেন বাহুল্য মনে হয়।
সত্যেন বলে ওঠেন, বউ তোমার এই সেমিজ বস্তুটি বিবাহিতাদের পক্ষে খুব সুবিধের হবে না। এ নিয়ে তোমাকে একটু ভাবনাচিন্তা করতে হবে মনে হচ্ছে।
সত্যেনের দুষ্টবুদ্ধিতে ছদ্মরোষে ঘুষি দেখান জ্ঞানদা। সত্যেন তা দেখে বলেন, সেকী বউ, স্বাধীন হয়ে প্রথমেই স্বামীপ্রহার করবে নাকি? গোঁড়া হিন্দুরা তো সে ভয়েই স্ত্রীলোকদের চারদেয়ালে বন্দি করে রাখে!
এবার দেখো না কী করি তোমায়, বলে অনেকটা ধাতস্থ জ্ঞানদা হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে সত্যেনের দিকে এগিয়ে এসে তার পুরুষালি ঠোঁটের ওপর নিজের কোমল ঠোঁটজোড়া স্থাপন করেন।
বুঝলেন স্বামী, এই শুরু হল স্বাধীনা নারীর স্বাধীন অভিসার। দীর্ঘ চুম্বনের পর ঠোঁট তুলে ঘোষণা করেন জ্ঞানদা।
০২. সারদাসুন্দরীর সংসার
ঠাকুরবাড়িতে সদর ও অন্দর সম্পূর্ণ আলাদা। সামনের দিকে লোহার ফটক পেরিয়ে পাশাপাশি দুটি বাড়ি। আদতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলির এই একটি বাড়ির দুটি ভাগ ছিল, বসতবাড়ি আর বৈঠকখানা বাড়ি। কিন্তু কিছুদিন আগে দেবেন আর গিরীন দুই ভাইয়ে বাড়ি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। এখন দেবেন সারদার সংসার দোতলা বসতবাড়িতে। তার মধ্যেও সদর অন্দরে কড়া বিভাজন। বারবাড়িতে কর্তাদের মহল, ছেলেদের মহল, চাকরদের মহল।
ভেতরমহল গিন্নিদের। সেই উঠোনের একধারে গোলাবাড়ি, সেখানে সারাবছরের ধান, ডাল মজুত থাকে। কিন্তু ঘি নুন তেল মশলার ভাণ্ডার বারবাড়িতে, সরকারদের হাতে। তারাই প্রতিদিনের মাপ অনুযায়ী বামুনদের হাতে বার করে দেয়। বিশাল রান্নাঘরে দশ-বারোজন বামুনঠাকুর ভোর থেকে রান্না চাপায়। রসুইঘরের দুদিকে পরিষ্কার সাদা কাপড় পেতে পাহাড়প্রমাণ ভাত রাখা হয়। সেই পরিমাণ ডাল, তরকারি, মাছের ঝোল রান্না করে পাথরের থালাবাটিতে সাজিয়ে তোক গুনে মহলে মহলে দিয়ে আসে বামুনরা। রাত্রে অবশ্য লুচি তরকারি খাওয়া হয়। এই ঢালাও রান্নার স্বাদ সবসময় পছন্দ হত না দেবেন্দ্রনাথের, তিনি বহুদিন প্রবাসে প্রবাসে কাটিয়ে ঘরে ফেরেন প্রিয় মানুষ আর প্রিয় রান্নার টানে। শুধু বামুনের হাতের রান্না খেলে তিনিও খাবারের স্বাদ ভুলে যাবেন আর ঘরের বউ-ঝিরাও রান্না ভুলে যাবে। তিনি সারদাসুন্দরীকে হুকুম দিলেন বউদের রান্না শেখাও। কত্তামশায় বাড়ি থাকলে সারদা তার গোলগাল চেহারা নিয়েও কষ্ট করে রান্নাঘরে গিয়ে বসতেন তদারকির জন্য। এবার কত্তার নির্দেশে অন্দরে বউমহলে মহা উৎসাহে শুরু হল রান্না নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা। সরকারি রসুইঘরের ঢালাও ডালঝোলের সঙ্গে বউদের সযত্নে রাঁধা ব্যঞ্জনের স্বাদে আকাশপাতাল তফাত। ঠাকুরবাড়ির রান্নার বিশিষ্ট ঘরানা গড়ে উঠছিল এইসব বিশেষ যত্নের রান্নাতেই।
সকালে উঠে সব মেয়ে-বউদের নিয়ম হল চান সেরে পট্টবস্ত্র পরে উপাসনাগৃহে জড়ো হওয়া। সমবেত উপাসনার শেষে যে যার ঘরে গিয়ে চেলি খুলে রেখে ধোয়া তাঁতের শাড়ি পরে এসে বসবেন ভাঁড়ারঘরের দাওয়ায়। সেই ভাঁড়ারঘরের বৈঠকটাই মেয়েমহলের প্রাণের আড্ডা। কত্তামা তক্তপোশে বসে নির্দেশ দেবেন আর গিন্নিরা বউরা মেয়েরা সব রান্নার জন্য তরকারি গুছিয়ে দেবেন। বৈষ্ণব আমল থেকেই তরকারি কাটা কথাটা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কাটা বললে পাছে হিংস্রতা প্রকাশ হয়। তাই বলা হত তরকারি বানানো। গিন্নিদের হাতে আছে সবজি ফলমূল আমসত্ত্ব নাড়ু বড়ি তিলকুটা সন্দেশের ভাঁড়ার। বউরা তো বটেই, বিবাহিতা ও অবিবাহিতা কন্যারাও এই আসরের তৎপর সদস্যা। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, বর্ণকুমারীরা মায়ের তত্ত্বাবধানে কাজ শেখেন।