পালকির ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়ে যা দেখলেন তা জীবনে দেখেননি বেচারি ঠানদিদি। আলোয় আলোয় রাতকে দিন করে ফেলা হয়েছে বেলগাছিয়া ভিলায়। ফোয়ারা আর নগ্নিকা নারীমূর্তি দিয়ে সাজানো বাগান, বিশাল স্তম্ভ ও বিরাট দালানের অসাধারণ কারুকার্য ভেদ করে দিদিঠাকরুন যখন সদলবলে ঢুকে পড়লেন হলঘরে, সে এক দৃশ্য। কাঁচের গেলাসের ঠুংঠাং শব্দ, বেলোয়ারি ঝাড়ের ঝলকানি ও মহার্ঘ বিদেশি আসবাবের মাঝখানে নৃত্যরত নারীপুরুষেরা হঠাৎ থেমে গেল। ঠানদিদি দেখলেন, সত্যিই মুসলমান বাবুর্চিরা টেবিলে টেবিলে মাছ মাংসের নানা পদ পরিবেশন করছে আর সাদা সাহেবগুলো বেহায়া মেমসাহেবদের কোমর জড়িয়ে নাচছে। আর স্বয়ং দ্বারকানাথকে দেখে তার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। একহাতে মদের গেলাস আর অন্য হাত এক গোরি মেমের কোমরে রেখে ইংরেজি গানের সঙ্গে সঙ্গে পা মিলিয়ে তিনি নাচছেন। এই অভাবনীয় দৃশ্যের সামনে স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দিদিঠাকরুনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। বালুচরী ঘোমটার আড়াল থেকেও ঠানদিদির রণচণ্ডী মেজাজ বোধহয় টের পেলেন দাদামশায়, একমুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলেন। তারপর এগিয়ে এসে ক্রুদ্ধ পত্নীকে সামলানোর চেষ্টা করতেই তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকে বিদ্ধ করে সদম্ভে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন দিদিঠাকরুন।
তা হলে ঠানদিদিই এই বাড়ির সবচেয়ে সাহসী স্ত্রীলোক, জ্ঞানদা বলেন, আমি তার মতো হতে চাই। তুমি একচুল বেচাল কিছু করলেই সংসর্গ ত্যাগ করব, সাবধান থেকো।
সত্যেন হেসে বলেন, আমি ভুল করলে সত্যিই কি তুমি তার মতো কঠোরহৃদয়া হতে পারবে? তিনি এরপরেও কী করেছিলেন জানো? দাদামশায় যখন নিত্যপূজার অধিকার হারালেন তখন দিদিঠাকুরানির মনে প্রশ্ন এল, স্বামী সংসর্গ করলে তিনিও কি ধর্মচ্যুত হবেন না? তখন তিনি ব্রাহ্মণদের পরামর্শ নিয়ে ঠিক করলেন স্বামীর যত্নআত্তি করবেন, তারপর স্নান করে শুদ্ধ হবেন, কিন্তু রাতে স্বামীসংসর্গ করবেন না।
ওমা সে কী গো? তোমাদের গোঁড়া সংসারে দিদিঠাকুরানি এমন কাজ করলেন কী সাহসে? জ্ঞানদা অবাক হন।
সত্যেন জ্ঞানদার মাথা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলেন, তার যা সাহস ছিল সে তোমাদের নেই জ্ঞেনু। তিনি ক্রমশ দাদামশায়ের অন্দরে প্রবেশ বন্ধ করে দিলেন, তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হল বৈঠকখানাঘরের একটি শয্যা। আলাদা রান্নার ব্যবস্থা হল তার জন্য। ঠানদিদি আর দাদামশায়ের সংসারের হাঁড়ি ভিন্ন হয়ে গেল।
বারো বছরের জ্ঞানদা অবাক হয়ে বলেছিলেন, এমা, স্বামীকে আলাদা করে দেওয়া কি ভাল? মেয়েমানুষের এমন অধর্মের কাজ করতে বাধল না?
দেখো জ্ঞেনু, ধর্ম অধর্মের বিচার করা বড় কঠিন, সত্যেন সেদিন বলেছিলেন, আমার দিদিঠাকুরানি ভোর চারটে থেকে পুজো শুরু করতেন। স্বপাক নিরামিষ আহার করতেন। এক বামুন ঠাকুর তার পুজোর ও রান্নার উপকরণ গুছিয়ে দিত। একাদশীতে ফলমূল খেয়ে কাটাতেন, উপোসও করতেন কোনও কোনও একাদশীতে। তাঁর সাত্ত্বিক জীবনের সঙ্গে দাদামশায়ের ভূমিকা মেলাতে পারেননি বলেই স্বামীসহবাসের সুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। স্বামীর চেয়েও তার কাছে বড় ছিল ধর্ম।
সধবার আবার একাদশী কী? জ্ঞানদা আরও অবাক হয়ে সেদিন বলেছিলেন।
শুনেছি দিদিঠাকরুন বিশ্বাস করতেন তার উপোসে স্বামীর অমঙ্গলের চেয়ে মঙ্গলই বেশি হবে, কারণ স্বামীর কল্যাণের জন্যই তো তার ব্রতপালন। সেই অনুরক্ত পত্নী কেন এত কঠোর হয়ে উঠলেন সেটাও তো ভেবে দেখতে হবে জ্ঞানদা।
এ-সব পুরনো কথা ভাবতে ভাবতেই ক্লান্তিতে একটু চোখ বুজে এসেছিল সত্যেনের। ঘুমের চটকা ভাঙল জ্ঞানদার কোমল করম্পর্শে। অন্য মেয়েরা কখন চলে গেছে। স্নান সেরে মিহি তাঁতের নীলাম্বরী শাড়ি পরেছেন জ্ঞানদা। খোঁপার বকুলফুলের মালা থেকে আসা গন্ধ সদ্য প্রবাসফেরত সত্যেনকে যেন বাংলামাটির পক্ষ নিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। ঘরের নিভৃতে আর জ্যাকেট গায়ে দেননি জ্ঞানদা, কিন্তু আদুল গায়েও তিনি আর থাকতে পারেন না। তাতে নিজেকে কেমন গ্রামীণ মনে হয়। পাতলা মলমলের সেমিজের ওপর তিনি সুন্দর পরিপাটি করে শাড়ি জড়িয়েছেন। সামান্য আতর তার সাজকে আরও মোহময় করেছে। যাকে তিনি এই প্রাসাদের চৌহদ্দি থেকে বার করে বোম্বাই নিয়ে গিয়েছিলেন এ মেয়ে সে মেয়ে নয়। জ্ঞানদার কোমর জড়িয়ে ধরে সত্যেন বলেন, মনে পড়ে জ্ঞেনু, বোম্বাইতে আমাদের সেই প্রথম ডিনার পার্টিতে তুমি কী করেছিলে?
আহা, তখন আমি সবে চৌকাঠ পেরোনো চোদ্দো বছরের এক বাঙালি বউ, আমি কী করে গোরা সাহেবদের কায়দাকানুন বুঝব? আমি প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলুম টেবিলে খাবার দাবার সব সাজিয়ে দেব অতিথিদের জন্য, কিন্তু আমি টেবিলে বসব না। ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে একসঙ্গে খানাপিনার কথা ভাবতেই পারিনি। আর সেই গোরা সাহেবটা যেই আমার হাত তার হাতের মধ্যে নিয়ে টেবিলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল, আমি ভাবলাম এ কী অসভ্য লোক রে বাবা! হাত ছাড়িয়ে দিলেম ছুট।
তারপর সেই বন্ধ দরোজা খোলানোর জন্য আমাকে কম সাধ্যসাধনা করতে হয়নি! সত্যেন হা হা করে হেসে ওঠেন, সেদিনের জন্য আমি তোমাকে দোষ দিই না, কিন্তু পরে তুমি যে ক্রমশ আদবকায়দা শিখে নিয়ে প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ানের যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠেছ সেজন্য আমার গর্ব হয়।