মানদা দাসী জানায় খাবার যাচ্ছে কর্তামা। সত্যেন ঘরের দিকে পা বাড়ালে তাঁর চোগা-চাপকান পরা দীর্ঘ অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মানদার কাছে সারদা জানতে চান, কী রে, যেভাবে বলেছি তাই পাঠানো হল?
হ্যাঁ মা, মানদা জানায়, রুপোর রেকাবিতে নারকেলের মিষ্টি, আনন্দনাড়ু, লুচি, বেগুনভাজা সাজিয়ে লেসের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে পাঠানো হয়েছে রুপোর গেলাসে বরফ দেওয়া তরমুজের শরবত।
ঈষৎ চিন্তিত মুখে রুপোর মকরমুখী পানবাটা থেকে পান মুখে দিয়ে তাকিয়ায় হেলান দেন সারদা। মানদা দাসী তার পা টিপতে থাকে।
ওদিকে সত্যেন ঘরে পৌঁছে দেখেন পালঙ্কের পাশে কাঠের ছোট জলচৌকির ওপর রুপোর রেকাবি ভরা খাবার ও শরবতের বিপুল আয়োজন। ওদিকে সামনের বারান্দায় মাদুর পেতে জ্ঞানদাকে ঘিরে জমিয়ে বসেছে মেয়ে-বউয়ের দল। থাক ওরা, একটু প্রাণ খুলে গল্পগাছা করুক। সত্যেন হাতমুখ ধুয়ে খাবারে হাত ঠেকান। তার মনে পড়ে যায় জ্ঞানদাকে এই দালান থেকে বার করতে কী বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথম যেবার আই সি এস পরীক্ষা দিতে লন্ডন গেলেন, সেখানকার স্বাধীন বিদেশিনিদের দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। তার মনে হয় এই তো আদর্শ সমাজ। মেয়েরা যে এত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরে বাইরে তাতে তো কই সংসারের ছন্দে বিন্দুমাত্র ঘা লাগছে না, বরং শিক্ষিত রুচিশীল সব কাজে পটু এই বিলিতি মেয়েরা যেন পুরুষের যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে উঠেছে। আমাদের বাঙালি মেয়েরাই বা কেন এমন হবে না! তখন থেকেই তার মাথায় চিন্তা শুরু হল কী করে জ্ঞানদাকে বিলেতে আনা যায়। সে যখন এখানে এসে এইসব বিলিতি মেয়েদের স্বাধীনতার আনন্দ নিজের চোখে দেখবে তখন সেও নিজেকে পালটাতে চাইবে।
ইংরেজ মেয়েদের দেখে মুগ্ধ হলেও সত্যেন এক মুহূর্তের জন্যও নিজের তেরো বছর বয়সি স্ত্রীকে ভোলেননি। দাদামশায় দ্বারকানাথও লন্ডনে গিয়ে বিলিতি মেয়েদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে মিষ্টিমধুর মেলামেশায় বা টেমসের বুকে বিলাসনৌকো ভাসিয়ে মেমদের সঙ্গে নৌকোবিহারে তিনি জীবনের স্বাদ উপভোগ করেছেন। সে ছিল তার নিজের মুক্তি। ম্লেচ্ছ সংসর্গে ধর্মনাশের আশঙ্কায় স্ত্রী দিগম্বরী তাঁকে প্রায় ত্যাগ করেছিলেন। বহু ধনসম্পদ কীর্তি ও মানমর্যাদা সত্ত্বেও স্ত্রীকে তিনি নিজের মতে আনতে পারেননি। রাজকীয় মেজাজের দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলার পার্টিতে সুরা ও মাংসের ফোয়ারা আর মেমসাহেবদের কোমর জড়িয়ে বল ডান্স নিয়ে সেকালে কেচ্ছা কেলেঙ্কারি ছড়া প্রশস্তির বন্যা বয়ে যেত। রূপচাঁদ পক্ষী মশাই ব্যঙ্গ করে ছড়া বেঁধেছিলেন,
কি মজা আছে রে লাল জলে জানেন ঠাকুর কোম্পানি
মদের গুণাগুণ আমরা কি জানি, জানেন ঠাকুর কোম্পানি।
তবু দ্বারকানাথের থেকেও সত্যেনকে মুগ্ধ করেন দিগম্বরী। জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ ছিল তাঁর কিন্তু সত্যেন জানেন দিদিঠাকুরানির তেজও কম ছিল না। তিনি লোকের কথায় আস্থা না রেখে একদিন রাতে পার্টি চলাকালীন ঘেরাটোপের পালকি চেপে সদলবলে হানা দেন বেলগাছিয়া ভিলায়। সেদিনের এক অভিজাত পরদানশিন মহিলার পক্ষে কাজটা ছিল যথেষ্ট বেপরোয়া। অথচ শুরুতে তাদের সম্পর্কটা যথেষ্ট মধুর ছিল। তখন বৈষ্ণব দ্বারকানাথ নিজ হাতে বাড়ির লক্ষ্মী জনার্দনের পূজা করতেন আর তার যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন রাইকিশোরী দিগম্বরী। ধূপধুনোর আঁচে তাঁর দুধেআলতা মুখে যে অপরূপ ভক্তি ও লাবণ্য ফুটে উঠত সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হতেন রূপের পূজারি দ্বারকানাথ। সেসময় তারা এত গোঁড়া ছিলেন যে বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন মাছ মাংস কিছুই ঢুকত না। ব্যাবসায় অভাবনীয় সাফল্য আসা শুরু হতে সাহেবমেমদের সঙ্গে মেলামেশার প্রয়োজন বাড়ল দ্বারকানাথের, নবযুগের চিন্তার ছোঁয়ায় আর বাবুয়ানির আকর্ষণে সেই গোঁড়া হিন্দুয়ানির প্রতি আস্থা ক্রমশ টলে গেল। বামুন পণ্ডিতেরা জানিয়ে দিলেন দ্বারকার নিজে হাতে পুজো করা আর চলবে না, সাহেবদের সংস্পর্শে তিনি অশুচি হয়েছেন। তারপর দিগম্বরী যা যা করেছেন, সবই ইতিহাস।
বিলেত যাবার আগে সত্যেন একদিন কিশোরী জ্ঞানদাকে উসকানি দেওয়ার জন্য দিগম্বরীর সেই আশ্চর্য কাণ্ডের কথা বলছিলেন, আমার দিদিঠাকরুন কী দস্যি মেয়ে ছিলেন সে তোমরা ভাবতেও পারবে না জ্ঞেনু। কিছুদিন ধরেই তার কানে আসছিল দাদামশায় নাকি ইদানীং বেলগাছিয়া ভিলায় সাহেবমেমদের সঙ্গে পানাহার করেন, মুসলমান বাবুর্চির রান্না মাংস খান। ঠানদিদি প্রথমে বিশ্বাস করেননি। শুনতে শুনতে উত্ত্যক্ত হয়ে একদিন ঠিক করলেন স্বচক্ষে দেখবেন কী হয় সেখানে। তখনকার পরদানশিন গৃহবধূর পক্ষে কী দুঃসাহসিক কাণ্ড ভাবো!
ওরে বাবা, আমার তো শুনেই বুক ঢিবঢিব করছে। জ্ঞানদা জানতে চান, ঠানদিদি একা একাই গেলেন সেখানে?
না, সঙ্গে নিলেন আমার মা আর অন্তঃপুরের দু-একজন মহিলাকে। হলুদ পাড় লাল সাটিনের ঘেরাটোপ দেওয়া ঠাকুরবাড়ির তিনটি পালকি গিয়ে থামল বেলগাছিয়া ভিলায়। মা তো তখন খুব ছোট। পরে মায়ের কাছে। শুনেছি সেদিন নাকি ভয়ে তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
তারপর কী হল? কী দেখলেন সেখানে?