সত্যেন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, মাগো অত রাগ করছ কেন? সত্যিই তো এটা ইতিহাস। বাইরে বেরলে দেখতে মরাঠি মেয়েরা হাবভাব চালচলনে বাঙালিনীদের চেয়ে কত এগিয়ে গেছে, তাদের দেখলে তুমিও বুঝতে কোমলেকঠিনে গড়া সেই ব্যক্তিত্বই বাঙালি নারীর আদর্শ হওয়া উচিত। মায়ের পাশটিতে চুপ করে বসে থাকা শাড়ি জড়ানো এক বালিকার ঝুটি নেড়ে দিয়ে সত্যেন বলেন, হারে বর্ণ, তুই সত্যি করে বল তো মেজোবউঠানের মতো করে সাজতে চাস কি চাস না?
ছোটবোন বর্ণকুমারী চুপ করে থাকে, তার আশেপাশের বালিকা কিশোরীরা উসখুস করেও সারদার ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তবে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তারা একজন দুজন করে জ্ঞানদার কাছে গিয়ে কথাবার্তা শুরু করল। এই মেজোবউঠান অন্যরকম বলে চিরদিনই তাদের আকর্ষণের কেন্দ্র, তা ছাড়া তিনি সবাইকে নিয়ে চলতে জানেন। নতুনের প্রতি গোপন টান উসকে দিতে জানেন। বই-মালিনী জ্ঞানদার হাত ধরে গোমড়া মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
দু’বছর আগে মেজোবউয়ের বোম্বাইযাত্রা উপলক্ষে সাড়া পড়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। নানা প্রশ্ন, উদ্বেগ, উৎসাহ। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল কী পোশাক পরে যাবেন তিনি। অনেক ভেবেচিন্তে ফরাসি দরজির দোকানে অর্ডার দিয়ে তাঁর জন্য করানো হল অত্যাশ্চর্য এক ওরিয়েন্টাল ড্রেস। সে-ড্রেস অনভ্যস্ত বাঙালিনীর পক্ষে এমনই জটিল যে তিনি নিজে পরতে পারেননি, বাড়ির মেয়েরাও যখন সেই অদ্ভুত পোশাকে সাহায্য করতে পারল না, স্বয়ং সত্যেন হাত লাগালেন।
তখনই জ্ঞানদার মনে হয়েছিল যে, নারীমুক্তির জন্য সবার আগে দরকার বাঙালি নারীর পোশাকের সংস্কারমুক্তি। পশ্চিমি ড্রেসের দ্বারস্থ না হয়ে শাড়ি-পরার কেতাদুরস্ত ভঙ্গি খুঁজে বার করার কথা তখন থেকেই তাঁর মাথায়। ঢোকে। বোম্বাইয়ের পারশি মহিলাদের সহজ স্বচ্ছন্দ শাড়ি-পরার কেতা থেকেই তিনি পেয়ে গেলেন বাঙালিনির শাড়ির ধারণা।
ঠাকুরবাড়ির চার দেওয়ালে বন্দি মেয়েদের কাছে এখন তো তিনিই দুনিয়া দেখার জানালা। কত কী শেখার আছে, শোনার আছে তাঁর কাছে। একদিকে কর্তামার রক্তচক্ষুর ভয় আর অন্যদিকে জ্ঞানদার দুর্নিবার আকর্ষণ। গল্প করতে করতে তারা জ্ঞানদাকে তাঁর জন্য প্রস্তুত শোওয়ার ঘরের দিকে নিয়ে যায়। বই-মালিনীও তাদের সঙ্গ নিল। জ্ঞানদা নতুন বই দেখবেন।
সেদিকে তাকিয়ে সারদা বলেন, দেখ সত্যেন, তোর বাবামশায় ধর্ম। পরিবর্তন করে আমার জীবনের অর্ধেক অশান্তিতে ভরে দিয়েছেন, এখন। তুই আর স্ত্রীস্বাধীনতার ধুয়ো তুলে আমার মাথা খাস না।
ঠাকুরবাড়ি আদতে ছিল ঘোর বৈষ্ণব। লক্ষ্মীজনার্দন তাঁদের গৃহদেবতা। বাড়ির বউ-ছেলেরা বংশানুক্রমে পূজাপার্বণ পালন করে এসেছেন। দিদিশাশুড়ি অলকাসুন্দরী ও শাশুড়ি দিগম্বরীর কাছে নিষ্ঠাভরে পূজাপাঠের নিয়মকানুন শিখছিলেন সারদা। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ যখন হিন্দুয়ানির সব পৌত্তলিকতা বর্জন করে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন তখন শুরু হল সারদার আত্মিক সংকট। না পারলেন স্বামীর ধর্মকে অস্বীকার করতে, না পারলেন হিন্দুয়ানির সংস্কার বর্জন করতে। অথচ এই টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হলেন সারাজীবন। সত্যেন বুঝতে পারেন, মা সেই কথাই বলছেন। কিন্তু তিনি যেন পণ করেছেন জননীকে সংস্কারমুক্ত করার।
মা তুমি কেন বুঝতে চাও না, না পালটালে, সভ্যতা এগোয় না। তা সে ধর্মেই হোক আর সমাজজীবনে। যে দেশের মেয়েরা ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি, সে দেশ অন্ধকারে ডুবে থাকে। আর যদি শুধু পোশাক সংস্কারের কথা বলল, সে তো বাবামশায় নিজেই বোনেদের পোশাক নিয়ে কত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, আজ পেশোয়াজ তো কাল দিশি গাউন। মুসলমান দরজির তৈরি সে-সব পোশাক তুমিও তো তোমার মেয়েদের পরিয়েছ।
সারদা বলেন, সে তত বাধ্য হয়ে, ঢাকা পোশাক না হলে আদুল গায়ে শাড়ি জড়িয়ে তো বাড়ির মেয়েরা বাইরের পণ্ডিতমশায়ের কাছে পড়াশোনায় বসতে পারবে না।
ঠিক সেরকম মা, ঢাকা পোশাক না পরলে তোমার মেজোবউ কী করে সমাজে মিশবে? আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরকম কাপড় পরে তা না পরার মতোই। ওই পোশাকে ভদ্রসমাজে যাওয়া চলে না। আমার চাকরিসূত্রে কত বড় বড় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে ওকে। সত্যেন উৎসাহে বলেন।
সারদা মুখ গোমড়া করে বলেন, মেয়েমানুষের এত মেশামেশির দরকার কী বাপু বুঝি না। আমরা তো কোনওদিন বাড়ির বাইরে পা ফেলিনি, অনেক বলেকয়ে গঙ্গাচানে যাবার অনুমতি পেলে যেতে হয়েছে ঘেরাটোপে ঢাকা পালকি চেপে। ছোটবেলায় দু-চারবার তুই তো আমার সঙ্গে গিয়েছিস। দেখেছিস তো, বেহারারা পালকি সুষ্ঠু গঙ্গায় চুবিয়ে দিত দু-চারবার, সেই আমার গঙ্গাস্নান। আর সেই বাড়ির বউকে তুই কিনা নিয়ে এলি গাড়ি চাপিয়ে, তারপর চাকরবাকরের চোখের সামনে দিয়ে বেহায়া বেপরদা বউমানুষ হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ঢুকল! এই অনাছিষ্টি দেখার জন্য আমি বেঁচে রইলাম কেন?
ওহ মা, আমাদের বাড়িতে মুসলমানি পরদাপ্রথা থাকারই বা কী দরকার বলো তো? আমাদের মেয়েরা আর কতকাল নবাবি কয়েদখানায় বন্দি থাকবে?
সারদা বিরক্ত হন। যা তো এখন, আমাকে আর জ্বালাস না। ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে একটু কিছু মুখে দে। এত পথ পেরিয়ে যাত্রা করে এসে কোথায় মায়ের সঙ্গে দুটো ভালমন্দ কথা কইবি তা না, তর্ক জুড়েছিস। যা ঘরে যা। ও মানদা, ওদের ঘরে খাবার পাঠানো হয়েছে কি না দেখ তো।