এ তো গেল তাঁর আদরযত্নের পালা। কিন্তু সত্যেন্দ্রর আই সি এস পরীক্ষা দিতে বিলেত যাওয়াটা বোধহয় মায়ের পছন্দ হয়নি। মেজোছেলে চলে গেলে কর্তামা কী এক অজানা রাগে মেজোবউ জ্ঞানদার গয়না নিয়ে দুই মেয়েকে বিয়ের উপহার দেন। নিয়ে নেওয়া সেইসব গয়নার জন্য অবশ্য জ্ঞানদা শোক করেন না। কিন্তু বাবামশায় যখন শুনলেন, তিনি মায়ের ওপর খুব রাগ করেন আর জ্ঞানদার জন্য একটি হিরের কন্ঠি পাঠিয়ে দেন। আসলে চিরদিন অন্তঃপুরবাসিনী সারদা সেখানকার কোনও পরিবর্তন মানতে পারতেন না। জ্ঞানদা যেভাবে অন্দরমহলের রীতিনীতি না মেনে আধুনিকতার আমদানি করছিলেন তা সারদাকে রাগিয়ে তুলত। আর ঘরের বউয়ের জাহাজে পাড়ি দিয়ে বোম্বাইযাত্রা এবং সেই বিদেশবিভূঁইতে দু’বছর কাটিয়ে আসা যে তিনি কোনওমতেই হজম করতে পারবেন না সে তত জ্ঞানদা বুঝতেই পারছেন, এবার মায়ের সঙ্গে বসবাস আরও কঠিন হবে।
কিন্তু বোম্বাই যাওয়ার অনুমতি পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তাঁকে। সত্যেন বিলেত যাওয়ার পর থেকেই স্ত্রীকে ঘরের বাইরে বিশ্বের আলোকিত নারীদের মাঝখানে নিয়ে যেতে চাইতেন। সে যুগে পুরুষেরা কার্যসূত্রে বা ভ্রমণে বাইরে গেলেও স্ত্রীদের সঙ্গে নেওয়ার চল ছিল না। কিন্তু সত্যেন কোনওদিনই জ্ঞানদাকে ঘরে বন্দি রেখে নিজে প্রবাসে থাকতে চাননি। চিঠির পর চিঠিতে তিনি জ্ঞানদাকে ডাক পাঠাতেন। একবার লিখলেন, এখানে জনসমাজে যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু সুন্দর, প্রশংসনীয় স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাহার মূল।… আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।
এ সব চিঠি পড়ে মনে মনে নিজেকে সেই আলোকযাত্রার জন্য প্রস্তুত করছিলেন কিশোরী জ্ঞানদা। কিন্তু শেষপর্যন্ত বাবামশায়ের অনুমতি পাওয়া গেল না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে বোম্বাইয়ের কর্মস্থলে প্রবাসী হলেন সত্যেন আর জ্ঞানদা নিজেকে তৈরি করতে লাগলেন আরেকভাবে। সেজোদের হেমেন্দ্রনাথের কাছে বাড়ির মেয়ে-বউরা তখন বাংলা শিখতে শুরু করেছে। সেজোজা নীপময়ী আর ননদ সুকুমারী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারীদের সঙ্গে জ্ঞানদাও যোগ দিলেন সেই পাঠশালায়। শাশুড়ি অবশ্য মাঝেমাঝেই রাগ করে কথা বন্ধ করে দিতেন অবাধ্য মেজোবউয়ের সঙ্গে, কখনও শাস্তি দিতেন অন্য মেয়েদের তাঁর সঙ্গে মিশতে না দিয়ে। তাই নিয়ে দূর থেকে উদ্বিগ্ন হতেন সত্যেন্দ্র। জানতে পারলে রাগ করতেন দেবেন্দ্রনাথ। হয়তো এ-কারণেই দ্বিতীয়বার সত্যেন্দ্রর আবেদনে সম্মতি দিতে দেরি করেননি মহর্ষি। সেই সম্মতি বাঙালি মেয়ের জন্য বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছিল।
এর জেরে শাশুড়ির মনে জমা যত তিক্ততা অবশ্য সামলাতে হল। জ্ঞানদাকেই। তবু সংস্কারের সীমায় বাধা সারদাকে বুঝতে পারেন বলেই শাশুড়ির ওপর রাগ করেন না, ধমক খেতে হবে জেনেও একটু ঝুঁকে তাকে প্রণাম করেন জ্ঞানদা।
তক্তপোশে বসে বিরক্তি নিয়ে জ্ঞানদার বেশবাস দেখতে থাকেন সারদা, জানতে চান, এ আবার কী ছিরির শাড়ি পরা হয়েছে?
জ্ঞানদা উত্তর করেন, মা এ হল বোম্বাই দস্তুর শাড়ি-পরা। এভাবে পরলে বাইরের লোকের সামনে বেরনো যায়।
আর গায়ে ওটা কী পরেছ? মেমেদের মতো জ্যাকেট?
জ্ঞানদার মুখ একটু অপ্রতিভ হয়ে যায়। সত্যেন্দ্র উত্তর দেন, কেন মা তোমার ভাল লাগছে না দেখতে? এখন অভিজাত ভদ্র স্ত্রীলোকেরা এভাবেই শাড়ি পরে পশ্চিমে। এবার আমাদের মেয়ে-বউরাও পরবে।
সারদা মুখঝামটা দেন, থাক নিজের বউকে সঙ সাজাচ্ছ, আবার আমার ভালমানুষ বউ-মেয়েদের নিয়ে টানাটানি করতে হবে না। চিরকাল যেভাবে চলে এসেছে তাই চলবে। অন্দরের শুচিতা নষ্ট করতে আমি দেব না। মা ছেলের তরজা শুনতে শুনতে মেয়েরা মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে মেজোবউয়ের সাজ। মেমেদের মতো ভারী না হলেও জ্যাকেটটি বেশ লেস বসানো কায়দাকানুন করা। কোমরে জ্যাকেট যেখানে শেষ আর শাড়ির বাঁধন শুরু সেখানে উঁকি মারলে পাতলা কাপড়ের সেমিজ দেখা যাচ্ছে। মরচেরং রেশমের শাড়ির ওপর কালোসোনালিতে পারশি কাজ করা পাড় বসানো। শাড়ি পরার ধরনটি বেশ আলাদা, কোমরে কুঁচি দিয়ে পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে সামনে এনে আঁচলটি বাঁ কাঁধের ওপর ব্রোচ দিয়ে আটকানো, পায়ে মোজা ও বিলিতি জুতো। কারও কারও বেশ ভালই লাগল। সনাতনপন্থী কেউ কেউ মনে মনে সারদার পক্ষ নিলেন।
সারদা আবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, জানি না কী অলুক্ষুনে কাণ্ড হবে, বউকে গাড়ি চড়ালি, জাহাজে চড়ালি, ভিটেছাড়া করে বিদেশে নিয়ে রাখলি। নিন্দায় কান পাতা যাবে না। যত জ্বালা তো আমাকেই সইতে হবে।
হঠাৎ উঠোন থেকে দালানে ছুটে এসে জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে হইচই করে ওঠে এক পসারিণী। ওঃ মেজোবউঠান তুমি আজ যে কাণ্ড করে দেখালে, ইতিহাস হয়ে গেল গো। বাঙালি মেয়েরা একশো বছর পরেও তোমায় ধন্য ধন্য করবে।
জ্ঞানদা চমকে উঠে বলেন, ওমা, বই-মালিনী। তুই কখন এলি?
সারদা রাগে লাল হয়ে হাতপাখা ছুঁড়ে মারেন বইওলিকে। যাঃ ভাগ, তোর আর নাটক করতে হবে না। ও সব আদিখ্যেতা করলে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেব। ইতিহাস! ওফ কী আমার ইতিহাসের ব্যাখ্যাতা এলেন রে! যা ভাগ।