মৃণালিনী ঘাড় গোঁজ করে আধোস্বরে বললেন, আপনি আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলেন কেন?
তোমার রাগ হয়েছে বউ? রবি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আচ্ছা, তোমাকে ফেলে আর কোথাও যাব না।
পাশের গলিপথ দিয়ে বাসনওয়ালি হেঁকে যাচ্ছে। চুরি চাই খেলনা চাই বলে হাঁক পাড়ছে দুপুরের ফিরিওলা। অন্যদিন বাড়ির মেয়ে-বউদের সঙ্গে মৃণালিনীও চুড়িওলার কাছে বসে পড়েন কাঁচের চুড়ি পরতে।
আজ এতদিন পরে স্বামীকে কাছে পেয়েও মৃণালিনী কিছুটা দিশেহারা। তার ভয় যায় না। শ্বশুরবাড়িতে এসেই সরলা কিশোরী বধূটি দাম্পত্য বিচ্ছেদের যে ভয়ংকর রূপ দেখেছেন, তা তাকে দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করছে। স্বামীকে কাছে পাওয়ার মরিয়া তাড়নায় তিনি বলে ফেললেন, আপনি নতুনঠাকুরের মতো আমাকে একা ফেলে ঘুরে বেড়ালে আমিও আফিম খাব।
রবি শিউরে ওঠেন, এ কী কথা বললে ছোটবউ? ছিঃ, আর কখনও এমন কথা মুখে আনবে না। তার মুখটি উঁচু করে ধরে আবার বললেন, মনে থাকবে?
মৃণালিনী চুপ করে আছেন দেখে রবি তার চোখে মুখে ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গান গেয়ে ওঠেন,
ধীরি ধীরি প্রাণে আমার এসো হে
মধুর হাসিয়ে ভালবেসো হে,
কয়েকলাইন গানের পর মৃণালিনীর ঠোঁটের কাছে রবি তার নিজের ঠোঁট এগিয়ে এনে একটি সঘন চুম্বন দিতে চাইলেন।
মৃণালিনী কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা অভিমানে সেই বহুপ্রতীক্ষিত চুম্বন প্রত্যাখ্যান করে রবির হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে গেলেন।
তার ব্যবহারে রবিরও কিছুটা অভিমান হল, এত আদর করে কাছে। ডাকলেও পালিয়ে যায়, এ কেমন মেয়ে? সে কি নিতান্ত অবোধ? এখনও দাম্পত্যের মাধুর্য কিছুই বোঝে না? আন্না তড়খড়ের আহ্বান এড়িয়ে, লুসির ডাকে সাড়া না দিয়ে, স্বপ্নসুন্দরী বিলেতবালাদের উপেক্ষা করে এই অবোধ বালিকার জন্যই কি এতদিন বসে আছেন তিনি? রবির হতাশ লাগে। প্রেমের কবিতা তো অনেক লিখেছেন, কিন্তু একটি প্রগাঢ় প্রেমের জন্য, একজন তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা রক্তমাংসের প্রেমিকার জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে!
একলাঘরে লেখার টেবিলে বসেন রবি। চোখ বন্ধ করলে খাতায় কাদম্বরীর মুখ ভেসে ওঠে। তিনি লেখেন, হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত–এসব লেখা আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না!
সন্ধেবেলায় গলিপথে শব্দ ওঠে বেলফুল চাই, বেলফুল। দাসীরা মালা কিনে এনে বউ-মেয়েদের চুলে পরিয়ে দেয়। আজ সবাই মিলে মৃণালিনীকে সাজানো হচ্ছে। তার লম্বা চুলে বিবিয়ানা খোঁপা বেঁধে যত্ন করে বেলফুলের মালা জড়িয়ে দেয় তারা। রবি বাড়ি ফিরেছে এতদিন পর, মৃণালিনী স্বামীর ঘরে রাত কাটাবে। সৌদামিনী নীপময়ীরা আজ তাই ছোটবউয়ের সাজের তদারকিতে লেগে পড়েছেন।
রাতের আহারপর্ব শেষ হলে রবি বিষণ্ণমনে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। হঠাৎ আসা দখিনা হাওয়ায় ঘরের বাতি নিভে গেছে। নাকি কাদম্বরী এসে বাতি নিভিয়ে দিলেন? রবি চুপচাপ শুয়ে রইলেন। এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্কণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর দিল না।
রাইকিশোরী মৃণালিনীর এই সজল, অনুতপ্ত আত্মসমর্পণে রবি সহসা পুলকিত হন। তাঁর শরীর মনে আনন্দের শিহর জাগে। মৃণালিনীকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতেই কুহকিনীর মতো রবির সামনে এসে দাঁড়ালেন কাদম্বরী। রবি ধীরে ধীরে তাঁকে বললেন, হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
মৃদু হেসে রবির দিকে চাঁপার কলি আঙুলগুলি নাড়িয়ে মরীচিকার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন কাদম্বরী। জোড়াসাঁকোর খিলানে তাঁর আর কোনও চিহ্ন রইল না।