.
সে যাত্রা প্রাণে বাঁচলেও সবার মনেই ভয় ধরে গেল অভিযান নিয়ে। সেখানেই নোঙর ফেলা হল। যাত্রীদের উৎসাহ কমে রাত শেষের গ্যাসবাতির মতো টিমটিম করে জ্বলতে লাগল। রবির ভাষায়
.
যাত্রীদের উৎসাহ দেখিতে দেখিতে হ্রাস হইয়া গেল; সকালবেলায় যেমনতরো মুখের ভাব, কল্পনার এঞ্জিন-গঞ্জন গতি ও আওয়াজের উৎকর্ষ দেখা গিয়াছিল, বিকালে ঠিক তেমনটি দেখা গেল না। আমাদের উৎসাহ নোঙরের সঙ্গে সঙ্গে সাত হাত জলের নীচে নামিয়া পড়িল। একমাত্র আনন্দের বিষয় এই ছিল যে, আমাদিগকেও অতদূর নামিতে হয় নাই। কিন্তু সহসা তাহারই সম্ভাবনা সম্বন্ধে চৈতন্য জন্মিল। এ সম্বন্ধে আমরা যতই তলাইয়া ভাবিতে লাগিলাম ততই আমাদের তলাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা মনে মনে উদয় হইতে লাগিল। এই সময় দিনমণি অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন। বরিশালে যাইবার পথ অপেক্ষা বরিশালে না-যাইবার পথ অত্যন্ত সহজ ও সংক্ষিপ্ত এ বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে দাদা জাহাজের ছাতের উপর পায়চারি করিতে লাগিলেন। একটা মোটা কাছির কুণ্ডলীর উপর বসিয়া এই ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে হাস্যকৌতুকের আলো জ্বালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, কিন্তু বর্ষাকালের দেশালাই-কাঠির মতো সেগুলা ভালো করিয়া জ্বলিল না। অনেক ঘর্ষণে থাকিয়া থাকিয়া অমনি একটু একটু চমক মারিতে লাগিল। যখন সরোজিনী জাহাজ তাহার যাত্রীসমেত গঙ্গাগর্ভের পঙ্কিল বিশ্রামশয্যায় চতুর্বর্গ লাভ করিয়াছেন তখন খবরের কাগজের sad accident-এর কোঠায় একটিমাত্র প্যারাগ্রাফে চারিটিমাত্র লাইনের মধ্যে কেমন সংক্ষেপে নির্বাণমুক্তি লাভ করিব সে বিষয়ে নানা কথা অনুমান করিতে লাগিলাম। এই সংবাদটি এক চামচ গরম চায়ের সহিত অতি ক্ষুদ্র একটি বটিকার মতো কেমন অবাধে পাঠকদের গলা দিয়া নামিয়া যাইবে, তাহা কল্পনা করা গেল। বন্ধুরা বর্তমান লেখকের সম্বন্ধে বলিবেন, আহা কত বড়ো মহাশয় লোকটাই গেছেন গো, এমন আর হইবে না। এবং লেখকের পূজনীয়া ভ্রাতৃজায়া সম্বন্ধে বলিবেন, আহা, দোষে গুণে জড়িত মানুষটা ছিল, যেমন তেমন হোক তবু তো ঘরটা জুড়ে ছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। জাঁতার মধ্য হইতে যেমন বিমল শুভ্র ময়দা পিষিয়া বাহির হইতে থাকে, তেমনি বউঠাকুরানীর চাপা ঠোঁটজোড়ার মধ্য হইতে হাসিরাশি ভাঙিয়া বাহির হইতে লাগিল।
.
আকাশে তারা উঠেছে, মনোরম দখিনা বাতাসে খালাসিদের নামাজ পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে নীচ থেকে। এক পাগলা খালাসি মাথা ঝাঁকিয়ে তারের যন্ত্র বাজিয়ে গান ধরেছে।
রাত নামলে খাওয়াদাওয়া সেরে খোলা ডেকের ওপরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়লেন সবাই। এ যেন এক দীর্ঘ পিকনিকের মতো জীবনযাপন, এখানে ঘরের মতো আব্রু নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই, চার দেওয়ালের গণ্ডি নেই, সমাজের অনুশাসন নেই। কিন্তু আপনজনের মধ্যে শোক আছে, বাসনা আছে, অনুতাপ, স্নেহ ভালবাসা আছে। সুরেন কিছুক্ষণ সেতার বাজিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিবিও ঘুমন্ত।
অন্ধকার ছাদের ওপরে কেউ আধফোঁটা হাই তুলছে, কারও নাক ডাকছে। কোথায় লুকিয়ে আছে সেই তারকাটি, রবি আকাশের শত শত তারাদের মধ্যে খুঁজতে থাকেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ মাঝরাতে কীসের অদ্ভুত শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। আস্তে আস্তে চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করেন। তিনি কোথায়, অন্ধকারে কার যেন গোঙানির অস্ফুট আওয়াজ। উঠে বসে চোখ সইয়ে নিয়ে রবি একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন, ডেকের এক কোনায় মেজোবউঠানের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন জ্যোতিদাদা। বৃক্ষের গায়ে তরুলতার পরিচিত দৃশ্যটি যেন পালটে গেছে আজ রাতে।
নিস্তব্ধ রাত্রে জ্যোতির ডুকরে ওঠা ক্ষীণ গলার স্বর ভেসে এল, বিনোদিনীর ডাকিনীমায়ায় কেন ডুব দিলাম মেজোবউঠান! তাই তো অভিমান করে সে। চলে গেল!
মেজোবউঠান তার কান্না মুছিয়ে দিতে দিতে যেন কপালে চুম্বন করলেন। কাদম্বরীর সঙ্গে একটি আবেগঘন মুহূর্তের কথা মনে পড়ল রবির। জ্যোতি ও জ্ঞানদার অজ্ঞাতসারে নিবিড় রাত্রির নির্জন দর্শকটি আবার শুয়ে পড়লেন। আধোঘুমে তার মাথায় বাতাসের মতো স্পর্শ বুলিয়ে যাচ্ছেন নতুনবউঠান। তারপরেই কেন কে জানে তার বন্ধ চোখের সামনে মৃণালিনীর মুখ ভেসে উঠল। রবি নিজেও তো বালিকাবধূকে ফেলে রেখে চলে এসেছেন, সেও নতুনবউঠানের মতো অভিমানিনী হয়ে উঠবে না তো!
.
জাহাজ আপাতত থেমে রইল। জ্যোতি ও জ্ঞানদা বাচ্চাদের নিয়ে বির্জিতলাওয়ে ফিরে গেলেন। রবি জোড়াসাঁকোয় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলেন, এবার মৃণালিনীকে গড়েপিটে নিজের ছাঁচে ঢেলে নিতে হবে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছেন, স্ত্রীকে অন্য কোথাও ফেলে রাখা চলবে না। এখন থেকে তাকে সঙ্গে নিয়েই জোড়াসাঁকোয় থাকবেন।
নিজের ঘরে গিয়ে মৃণালিনীকে ডেকে পাঠালেন রবি। ভীরু পায়ে শিঞ্জিনী বাজিয়ে লালপেড়ে ঢাকাইশাড়ি পরা কিশোরীটিকে ঘরে ঢুকতে দেখে রবির মনে হয় এ তো আর ছোট নেই, এ যে রাইকিশোরী! হাত বাড়িয়ে তিনি বলেন, কাছে এসো।
মৃণালিনী আসেন না, মুখ নিচু করে দূরে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা মেঝেয় ঘসতে থাকেন।
মৃণালিনীর হাত ধরে কোলের কাছে টেনে আনেন রবি। জানতে চান, কী গো ছোটবউ, আমার কাছে আসবে না? ঘরে ফিরে এলাম, আর তুমি এমন দূরে দূরে থাকবে? আমি কি চলে যাব?