এই যে-সব গঙ্গার ছবি আমার মনে উঠিতেছে, এ কি সমস্তই এইবারকার স্টীমারযাত্রার ফল? তাহা নহে। এ-সব কতদিনকার কত ছবি, মনের মধ্যে আঁকা রহিয়াছে। ইহারা বড়ো সুখের ছবি, আজ ইহাদের চারি দিকে অশ্রুজলের স্ফটিক দিয়া বাঁধাইয়া রাখিয়াছি। এমনতরো শোভা আর এ জন্মে দেখিতে পাইব না।
ইতিমধ্যেই যাত্রীদের মধ্যাহ্নভোজন সারা হয়েছে। কেদারায় অর্ধশয়ান জ্ঞানদার মনে বিচিত্রভাবের আনাগোনা চলেছে। আজ আবার তার কাছে পুরোপুরি ফিরে এসেছে প্রিয় বাল্যসঙ্গী জ্যোতি। রবির সঙ্গে ছেলেমেয়েরা মেতে উঠেছে ব্রাইটনের দিনগুলোর মতো। আজ আর ওদের কোনও পিছুটান নেই, কাদম্বরী অপেক্ষা করে বসে নেই ঘরে। এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি, জ্যোতি ও রবির প্রতিভাকে আর কে লালন করবে তিনি ছাড়া? কাদম্বরী এই সুখ থেকে তাঁকে বঞ্চিত করেছিলেন, হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছিলেন তাঁর রাজ্যপাটে। শ্যাম গাঙ্গুলির মেয়ে বলে যাকে হেলাফেলা করেছিলেন, সেই এসে জ্ঞানদার পায়ের তলার জমি কেড়ে নিয়েছিল কিছুদিন। এখন সে আর নেই, কাপুরুষের মতো হার স্বীকার করে পালিয়ে গেছে। জ্ঞানদা আজ বিজয়িনী।
কিন্তু এই জয় কি তিনি চেয়েছিলেন? জ্যোতিকে নিজের বির্জিতলাওয়ের বাড়িতে রাতের পর রাত আটকে রেখে সত্যিই কি তিনি খুব নিষ্ঠুরতা করেছেন কাদম্বরীর ওপর? রূপা যা বলে গেল, সেটাই কি সত্যি? কাদম্বরীর মৃত্যুকে কি কোনওভাবে ঠেকাতে পারতেন জ্ঞানদা? জলের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে থাকেন জ্ঞানদা, ভাবতেই থাকেন।
এরমধ্যে মেরামত হয়ে জাহাজ চলতে শুরু করল। গঙ্গা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। কিছুদূর জলপথের আনন্দ উপভোগ করে সাড়েতিনটে নাগাদ ডেকের ওপর জমিয়ে শুরু হল ফলাহার।
রবি বললেন, মেজোবউঠান না এলে এমন খাওয়াদাওয়ার তরিবত থেকে বঞ্চিত হয়ে শুকিয়ে মরতে হত বোধহয়।
অক্ষয় গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজছিলেন। একটি রসালো আঙুর মুখে দিয়ে তিনি হঠাৎ বললেন, আজ তাঁকে খুব মনে পড়ছে।
রবির বুকে যে তীব্র শোক টইটম্বুর জলাধারের আকারে লুকিয়ে আছে, অক্ষয়ের একটি কথায় তা যেন বন্যার মতো উপচে পড়তে চাইল। লোকসমাজে যখন-তখন চোখের জল বেরিয়ে এলে তো চলবে না, রবি সম্প্রতি সেটা লুকোতে দুটি পন্থা নিয়েছেন। হয় হাসিঠাট্টার মোড়কে সব ঢেকে রাখছেন অথবা গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠছেন, যেমন এখন চট করে মুখ লুকিয়ে গেয়ে উঠলেন, আছে দুঃখ আছে মৃত্যু–
কী আশ্চর্য রবি, অক্ষয় বললেন, তাঁর মৃত্যুর কদিন আগেই ব্রাহ্মসমাজে গাইবার জন্য তুমি গানটি লিখেছিলে, কে জানত আমাদের চোখের জল ঢেকে রাখতে হবে এই গান দিয়ে। তিনিও গলা মেলান রবির সঙ্গে। বিবির রিনরিনে গলা যোগ হয়ে জাহাজের ডেকের ওপরে যেন নেমে এল সুরের ঝরনাধারা।
জ্যোতিও সেই শোকসংগীতের সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে নেমে আসতে লাগল বাধ না মানা অশ্রুরাশি।
তিনযুবকের এই অসংকোচ শোকে বড় বিব্রতবোধ করেন জ্ঞানদা। এখানেও যেন কাদম্বরী সশরীরে উপস্থিত। জ্যোতির অশ্রু নিজের আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেন জ্ঞানদা, তার মাথায় হাত দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেন শুশ্রূষায়।
জ্যোতি তাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠেন, আমার দোষেই কি সে চলে গেল, বলো মেজোবউঠান, তুমি বলো, আমার কি কোনও দোষ ছিল?
পরম মমতায় তাঁকে শান্ত করতে চান জ্ঞানদা, নতুনঠাকুরপো, তোমার কোনও দোষ নেই, তুমি তো তাকে ভালই বাসতে, সে অবুঝ ছিল বলে তোমাকে বুঝতে পারেনি।
কথাটা শেলের মতো রবির হৃদয়ে বাজে। অক্ষয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তাঁর। দুজনে দুজনের মনের ভাষা বুঝে নেন, অন্তরে যাই থাকুক, প্রকাশ্যে তাঁরা কিছুই বললেন না।
কিন্তু জ্যোতি এই নীরবতার মানে জানেন, দীর্ঘকালের সঙ্গী অক্ষয় যে মনে মনে তাকে অপরাধী ভাবছেন তা বুঝে কষ্ট পান। রবি তো গুমরে মরছে, অথচ প্রাণে ধরে দাদাকে দোষ দিতে পারছে না।
জ্ঞানদার আঁচল থেকে মুখ তুলে তিনি বলেন, মেজোবউঠান, জগতের সবাই যদি তোমার মতো করে ভাবত, তা হলে তো ভাবনার কিছু ছিল না। এই তো দেখছ না রবি আর অক্ষয় কেমন চুপ করে আছে। ওরা আমায় দোষী ভাবে, আমি তো জানি।
জ্ঞানদা ওঁদের মুখের দিকে তাকান। রবিকে যেন চোখের ইঙ্গিতে কিছু বলতে বলেন। রবি টলটলে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলেন, শুধু তোমার কেন, দোষ আমারও আছে।
যাত্রীদের মনের দোলাচলমানতার সঙ্গে তাল রেখে জাহাজ বেশ দুলছে। একটু বেশিই দুলছে, হঠাৎ মনে হল জ্ঞানদার। বড়বড় ঢেউ এসে জাহাজের পাঁজরে ধাক্কা মারছে সবেগে আর জাহাজ ছুটে চলছে উন্মত্ত বেগে।
কর্তাবাবু চালকের দিকে ছুটে গেলেন ওরে থাম থাম বলতে বলতে। নীচ থেকেও রব উঠল থামাও, থামাও।
সবাই সভয়ে দেখলেন জাহাজ একটি লোহার বয়ার দিকে ছুটে চলেছে অথবা বয়াটিই ছুটে আসছে ধাক্কা মারবে বলে। ধাক্কা মারলও। ভয়ংকর শব্দ করে বিকট দুলুনিতে জাহাজ থেমে গেল। কোনওরকমে প্রাণে বেঁচে গেলেন সবাই কিন্তু জাহাজ আর চলল না।
কয়েক ঘণ্টা পরে পরিবেশ শান্ত হলে ডেকে বসে বসে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতায় কৌতুক মিশিয়ে রবি তার ডায়েরিতে লিখতে লাগলেন, সত্য ঘটনায় ও উপন্যাসে প্রভেদ আছে। তাহার সাক্ষ্য দেখো আমাদের জাহাজ বয়ায় ঠেকিল, তবু ডুবিল না, পরম বীরত্বসহকারে কাহাকেও উদ্ধার করিতে হইল না, প্রথম পরিচ্ছেদে জলে ডুবিয়া মরিয়া ষড়বিংশ পরিচ্ছেদে কেহ ডাঙায় বাঁচিয়া উঠিল না। না ডুবিয়া সুখী হইয়াছি সন্দেহ নাই, কিন্তু লিখিয়া সুখ হইতেছে না; পাঠকেরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিরাশ হইবেন, কিন্তু আমি যে ডুবি নাই সে আমার দোষ নয়, নিতান্তই অদৃষ্টের কারখানা।