নৌকো থেকে জাহাজে ওঠাও একটা অ্যাডভেঞ্চার। মাঝগঙ্গা থেকে হুড়মুড় করে এগিয়ে আসা সরোজিনী জাহাজের গায়ে নিপুণ দক্ষতায় নৌকো লাগিয়ে দিল মাঝি। টলোমলো নৌকোর ওপর জাহাজ থেকে নামানো হল মই। বিবি আর সুরেন তো তরতর করে উঠে পড়ল। তারপর অতিযত্নে এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভেঙে জাহাজে পা রাখলেন জ্ঞানদা। পেছন পেছন জ্যোতি, রবি, অক্ষয়।
ছজন অভিযাত্রীকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজের জলযাত্রার প্রথম পর্ব শুরু হল বেশ রোমাঞ্চকরভাবেই। দুরন্ত গতিতে জাহাজ ছুটতে লাগল। ডেকের ওপরে চেয়ার পেতে বসতেই উথালপাতাল হাওয়ায় সকলের জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে গেল। বাতাসে রবির আচকান ফুলে উঠল নৌকোর পালের মতো, উড়নি উড়তে লাগল আকাশে। জ্ঞানদার খোলা চুল মাথার ওপর নাগিনীনৃত্য দেখাতে শুরু করল। বাতাসে পাখনা মেলে দিল তাঁর নয়নসুখ শাড়ি। বিবির বিলিতি ফ্রকের ঘের ব্যালেরিনার মতো গোল হয়ে ঘুরতে লাগল, জ্যোতির উত্তরীয় অভিযানের পতাকার মতো এগিয়ে চলল সামনের দিকে। নীচে মাটির জলরাশির অসংখ্য ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নেচে বেড়াচ্ছে সূর্যের আলো।
জ্ঞানদা আবেশভরে চোখ বুজে বললেন, নতুনঠাকুরপো, তোমার এই ডেকের ওপর আমি সারাজীবন থেকে যেতে পারি। গঙ্গাবক্ষে এই ভ্রমণের কোনও তুলনা হয় না।
দুটি চেয়ার পাশাপাশি গায়ে গা ঠেকিয়ে স্নেহভরে বসে আছে, জ্ঞানদাও একটু হেলে চেয়ারের পেছনদিকে মাথা রাখলেন। জাহাজের দুলুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরম আরামে তাঁর চোখ বুজে এল। গঙ্গার জলবাতাসে জ্যোতির উত্তেজিত স্নায়ুগুলিও বহুদিন পরে বিশ্রাম পেয়েছে, তিনিও বউঠানের মাথার পাশে মাথা রেখে মৃদু নাসিকা গর্জন শুরু করলেন।
আশেপাশে ছিপছিপে পানসিগুলো দু-একটি অফিসযাত্রী নিয়ে তরতর করে বয়ে চলেছে কোন এক ঘাটের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে আনমনে কী। ভাবছিলেন রবি। বিবি ও সুরেন তাঁর হাত ধরে কেবলই টানাটানি করছে।
এমন সময় জাহাজের বৃদ্ধকর্তাবাবু এসে বললেন, একটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার ঘটেছে, জাহাজ ছাড়ার পর টের পাওয়া গেছে যে কাপ্তেনটি পালিয়ে গেছে।
ঘুমঘোর ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসলেন জ্যোতি, কী হবে এখন? কাপ্টেন ছাড়া জাহাজ চলবে কী করে?
জ্ঞানদার চটকা ভেঙে গেল, দুটি বাচ্চা এবং তিনটি অর্বাচীন যুবকসঙ্গীকে নিয়ে এবার কি অথই জলে পড়তে চলেছেন। তিনি বলেন, তা হলে তো যাত্রা বন্ধ করে নোঙর ফেলাই ভাল।
জ্যোতি কিছুতেই দমবার পাত্র নন, তিনি অভিমত দিলেন, অন্যান্য কর্মচারীরাই বেশ জাহাজ টেনে নিয়ে যেতে পারবে, ক্যাপ্টেনের চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়।
বুড়োকর্তাও জ্যোতিকে সমর্থন করে বললেন জাহাজ থামানোর দরকার নেই, ওরাই চালিয়ে নেবে। জাহাজ অবশ্য চলতে চলতেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। শিবপুর বটানিকাল গার্ডেনের কাছাকাছি এসে দেখা গেল জাহাজের হৃদয়ে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে না, কল চলছে না। কী একটা যন্ত্র খুলে গেছে, মেরামত করতে হবে। দু-তিনঘন্টার জন্য সেখানেই নোঙর ফেলতে হল জ্যোতিকে।
গঙ্গার শোভা দেখতে দেখতেই রবির মনে পড়ে যায় নতুনবউঠানের সঙ্গে গঙ্গাতীরের সুখের দিনগুলি। কত ছবি। কত দৃশ্য। সেইসব সুখের ছবির সঙ্গে মিলে যেতে থাকে আজকের গঙ্গা, রবি ডায়েরিতে লিখতে থাকেন,–
বসিয়া বসিয়া গঙ্গাতীরের শোভা দেখিতে লাগিলাম। শান্তিপুরের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গাতীরের যেমন শোভা এমন আর কোথায় আছে। গাছপালা ছায়া কুটীর–নয়নের আনন্দ অবিরল সারি সারি দুই ধারে বরাবর চলিয়াছে, কোথাও বিরাম নাই। কোথাও বা তটভূমি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন হইয়া গঙ্গার কোলে আসিয়া গড়াইয়া পড়িয়াছে; কোথাও বা একেবারে নদীর জল পর্যন্ত ঘন গাছপালা লতাজালে জড়িত হইয়া ঝুঁকিয়া আসিয়াছে, জলের উপর তাহাদের ছায়া অবিশ্রাম দুলিতেছে; কতকগুলি সূর্যকিরণ সেই ছায়ার মাঝে মাঝে ঝিমি করিতেছে, আর বাকি কতকগুলি–গাছপালার কম্পমান কচি মসৃণ সবুজ পাতার উপরে চিকচিক্ করিয়া উঠিতেছে। একটা বা নৌকা তাহার কাছাকাছি গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা রহিয়াছে, সে সেই ছায়ার নীচে, অবিশ্রাম জলের কুলকুল শব্দে মৃদু মৃদু দোল খাইয়া বড়ো আরামের ঘুম ঘুমাইতেছে। তাহার আর-এক পাশে বড়ো বড়ো গাছের অতি ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া ভাঙা ভাঙা বাঁকা একটা পদচিহ্নের পথ জল পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। সেই পথ দিয়া গ্রামের মেয়েরা কলসী কাঁখে করিয়া জল লইতে নামিয়াছে, ছেলেরা কাদার উপরে পড়িয়া জল ছোঁড়াছুঁড়ি করিয়া সাঁতার কাটিয়া ভারি মাতামাতি করিতেছে। প্রাচীন ভাঙা ঘাটগুলির কী শোভা! মানুষেরা যে এ ঘাট বাঁধিয়াছে তাহা একরকম ভুলিয়া যাইতে হয়; এও যেন গাছপালার মতো গঙ্গাতীরের নিজস্ব। ইহার বড়ো বড়ো ফাটলের মধ্য দিয়া অশথগাছ উঠিয়াছে, ধাপগুলির ইটের ফাঁক দিয়া ঘাস গজাইতেছে– বহু বৎসরের বর্ষার জলধারায় গায়ের উপরে শেয়ালা পড়িয়াছে–এবং তাহার রঙ চারি দিকের শ্যামল গাছপালার রঙের সহিত কেমন সহজে মিশিয়া গেছে। মানুষের কাজ ফুরাইলে প্রকৃতি নিজের হাতে সেটা সংশোধন করিয়া দিয়াছেন; তুলি ধরিয়া এখানে ওখানে নিজের রঙ লাগাইয়া দিয়াছেন। অত্যন্ত কঠিন সগর্ব ধবধবে পারিপাট্য নষ্ট করিয়া, ভাঙাচোরা বিশৃঙ্খলা মাধুর্য স্থাপন করিয়াছেন। গ্রামের যে-সকল ছেলেমেয়েরা নাহিতে বা জল লইতে আসে তাহাদের সকলেরই সঙ্গে ইহার যেন একটা-কিছু সম্পর্ক পাতানো আছে– কেই ইহার নাতনি, কেহ ইহার ভাগনে, কেহ ইহার মা-মাসি। তাহাদের দাদামহাশয় ও দিদিমারা যখন এতটুকু ছিল তখন ইহারাই ধাপে বসিয়া খেলা করিয়াছে, বর্ষার দিনে পিছল খাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। আর সেই-যে যাত্রাওয়ালা বিখ্যাত গায়ক অন্ধ শ্রীনিবাস সন্ধ্যাবেলায় ইহার পইঠার উপর বসিয়া বেহালা বাজাইয়া গৌরী রাগিণীতে গেল গেল দিন গাহিত ও গাঁয়ের দুই-চারিজন লোক আশেপাশে জমা হইত, তাহার কথা আজ আর কাহারও মনে নাই। গঙ্গাতীরের ভগ্ন দেবালয়গুলিরও যেন বিশেষ কী মাহাত্ম্য আছে। তাহার মধ্যে আর দেবপ্রতিমা নাই। কিন্তু সে নিজেই জটাজুটবিলম্বিত অতি পুরাতন ঋষির মতো অতিশয় ভক্তিভাজন ও পবিত্র হইয়া উঠিয়াছে। এক-এক জায়গায় লোকালয়– সেখানে জেলেদের নৌকা সারি সারি বাঁধা রহিয়াছে। কতকগুলি জলে, কতকগুলি ডাঙায় তোলা, কতকগুলি তীরে উপুড় করিয়া মেরামত করা হইতেছে; তাহাদের পাঁজরা দেখা যাইতেছে। কুঁড়েঘরগুলি কিছু ঘন ঘন কাছাকাছি–কোনো-কোনোটা বাঁকাচোরা বেড়া দেওয়া–দুই চারিটি গোরু চরিতেছে, গ্রামের দুই-একটা শীর্ণ কুকুর নিষ্কর্মার মতো গঙ্গার ধারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে; একটা উলঙ্গ ছেলে মুখের মধ্যে আঙুল পুরিয়া বেগুনের খেতের সম্মুখে দাঁড়াইয়া অবাক হইয়া আমাদের জাহাজের দিকে চাহিয়া আছে। হাঁড়ি ভাসাইয়া লাঠি-বাঁধা ছোটো ছোটো জাল লইয়া জেলের ছেলেরা ধারে ধারে চিংড়িমাছ ধরিয়া বেড়াইতেছে। সমুখে তীরে বটগাছের জালবদ্ধ শিকড়ের নীচে হইতে নদীস্রোতে মাটি ক্ষয় করিয়া লইয়া গিয়াছে, ও সেই শিকড়গুলির মধ্যে একটি নিভৃত আশ্রয় নির্মিত হইয়াছে। একটি বুড়ি তাহার দুই চারিটি হাঁড়িকুড়ি ও একটি চট লইয়া তাহারই মধ্যে বাস করে। আবার আর-এক দিকে চড়ার উপরে বহুদূর ধরিয়া কাশবন; শরৎকালে যখন ফুল ফুটিয়া উঠে তখন বায়ুর প্রত্যেক হিল্লোলে হাসির সমুদ্রে তরঙ্গ উঠিতে থাকে। যে কারণেই হউক, গঙ্গার ধারের হঁটের পাঁজাগুলিও আমার দেখিতে বেশ ভালো লাগে; তাদের আশেপাশে গাছপালা থাকে না, চারি দিকে পোড় জায়গা এবড়ো-খেবড়ো, ইতস্তত কতকগুলো ইট খসিয়া পড়িয়াছে, অনেকগুলি ঝামা ছড়ানো, স্থানে স্থানে মাটি কাটা–এই অনুর্বরতা-বন্ধুরতার মধ্যে পাঁজাগুলো কেমন হতভাগ্যের মত দাঁড়াইয়া থাকে। গাছের শ্রেণীর মধ্য হইতে শিবের দ্বাদশ মন্দির দেখা যাইতেছে; সমুখে ঘাট নহবতখানা হইতে নহবত বাজিতেছে। তাহার ঠিক পাশেই খেয়াঘাট। কাঁচা ঘাট, ধাপে ধাপে তালগাছের গুঁড়ি দিয়া বাঁধানো। আর, দক্ষিণে কুমারদের বাড়ি, চাল হইতে কুমড়া ঝুলিতেছে। একটি প্রৌঢ়া কুটীরের দেওয়ালে গোবর দিতেছে; প্রাঙ্গণ পরিষ্কার, তক্ত করিতেছে; কেবল এক প্রান্তে মাচার উপরে লাউ লতাইয়া উঠিয়াছে, আর-এক দিকে তুলসীতলা। সূর্যাস্তের নিস্তরঙ্গ গঙ্গায় নৌকা ভাসাইয়া দিয়া গঙ্গার পশ্চিম-পারের শোভা যে দেখে নাই সে বাংলার সৌন্দর্য দেখে নাই বলিলেও হয়। এই পবিত্র শান্তিপূর্ণ অনুপম সৌন্দর্যচ্ছবির বর্ণনা সম্ভবে না। এই স্বর্ণচ্ছায়া ম্লান সন্ধ্যালোকে দীর্ঘ নারিকেলের গাছগুলি, মন্দিরের চূড়া, আকাশের পটে আঁকা নিস্তব্ধ গাছের মাথাগুলি, স্থির জলের উপরে লাবণ্যের মতো সন্ধ্যার আভাসুমধুর বিরাম, নির্বাপিত কলরব, অগাধ শান্তি–সে-সমস্ত মিলিয়া নন্দনের একখানি মরীচিৎকার মতো, ছায়াপথের পরপরবর্তী সুদূর শান্তিনিকেতনের একখানি ছবির মতো পশ্চিমদিগন্তের ধারটুকুতে আঁকা দেখা যায়। ক্রমে সন্ধ্যার আলো মিলাইয়া যায়, বনের মধ্যে এ দিকে ও দিকে এক-একটি করিয়া প্রদীপ জ্বলিয়া উঠে, সহসা দক্ষিণের দিক হইতে একটা বাতাস উঠিতে থাকে, পাতা ঝরঝক্ করিয়া কাঁপয়া উঠে, অন্ধকারে বেগবতী নদী বহিয়া যায়, কূলের উপরে অবিশ্রাম তরঙ্গ-আঘাতে ছলছল করিয়া শব্দ হইতে থাকে–আর কিছু ভালো দেখা যায় না, শোনা যায় না, কেবল ঝিঁঝি পোকার শব্দ উঠে, আর জোনাকিগুলি অন্ধকারে জ্বলিতে নিবিতে থাকে। আরও রাত্রি হয়। ক্রমে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ ঘোর অন্ধকার অশথগাছের মাথার উপর দিয়া ধীরে ধীরে আকাশে উঠিতে থাকে। নিম্নে বনের শ্রেণীবদ্ধ অন্ধকার, আর উপরে ম্লান চন্দ্রের আভা। খানিকটা আলো অন্ধকার-ঢালা গঙ্গার মাঝখানে একটা জায়গায় পড়িয়া তরঙ্গে তরঙ্গে ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়। ও পারের অস্পষ্ট বনরেখার উপর আর-খানিকটা আলো পড়ে, সেইটুকু আলোতে ভালো করিয়া কিছুই দেখা যায় না; কেবল ও পারের সুদূরতা ও অস্ফুটতাকে মধুর রহস্যময় করিয়া তোলে। এ পারে নিদ্রার রাজ্য আর ও পারে স্বপ্নের দেশ বলিয়া মনে হইতে থাকে।