ছটফট করে উঠে মৃণালিনী বলে ফেলেন, আচ্ছা, নতুনবউঠান নিশ্চয় নতুনঠাকুরের কাছ থেকে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, নইলে এমন সুখের সংসার ছেড়ে শখ করে কেউ আফিম খায়?
জ্ঞানদা চুপ করে বসে থাকেন, বিড়বিড় করে বলেন, নতুনের কোনও দোষ নেই, প্রথমেই বলেছিলাম, এ বিয়েটা ভাল হবে না! ওর মতো উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে বেঁধে রাখার ক্ষমতা নতুনবউর ছিল না, তাই নিজেই আত্মঘাতী হল।
রূপা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে, তুমিই ওকে মেরেছ, তুমি আর জ্যোতিদাদা। তোমার ঈর্ষার বিষে তিলতিল করে মরতে মরতে আফিম খেয়ে নিল নতুনবউঠান। আমি এখন কার কাছে থাকব? সামনে সাজানো ফলমিষ্টির থালায় লাথি মেরে, গ্লাস উলটে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রূপা, কোনও এক অনির্দেশের উদ্দেশে।
ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় মৃণালিনীর। মুহূর্তের জন্য জ্ঞানদার স্নিগ্ধবোধ টলে যায়, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবেন, সত্যিই কি তিনি কাদম্বরীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন? মুখে মেঘ ও রোদের দোলাচল নিয়ে তিনি ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
.
কাদম্বরীর মৃত্যুতে ভারতীরও মৃত্যু হল। সবাই যেন পত্রিকা প্রকাশের উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। ভারতাঁকে ঘিরে জড়ো হওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একত্র করে একটি তোড়া বেঁধেছিলেন কাদম্বরী, তার অনুপস্থিতিতে সেই বাঁধনটিই। ছিঁড়ে গেল। শেষের দিকে জ্ঞানদার বাড়িতে ভারতীর মিটিং বসলেও সবাই যেন মনে মনে জানতেন, সে সাময়িক। ভারতীর আসল ঠিকানা কাদম্বরীর তেতলার ঘর।
নতুনবউঠানকে ছাড়া রবির আর সম্পাদনার কাজ করতে ইচ্ছে করে না। তিনি লেখা আর কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনায় মন দিয়েছেন, পরপর চারটি বই বেরল, তার মধ্যে শৈশবসঙ্গীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ ও ভানুসিংহের পদাবলী তিনটিই উৎসর্গ করলেন নতুনবউঠানকে।
জ্যোতির পক্ষে তো সময় দেওয়া বা মনস্থির করে কাজ করা এখন অসম্ভব, তিনি দিনের বেলা উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ান, রাত্রে থাকেন মেজোবউঠানের কাছে বা বিনোদিনীর বাড়িতে। একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভারতীর প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হল।
কিন্তু ভারতীর মৃত্যুসংবাদ স্বর্ণকুমারী মোটেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার বিবেচনায় ব্যক্তিগত শোকের চেয়ে কাজ অনেক বড়। ভাইদের উদাসীনতায় পত্রিকা উঠে যাবে, এ কেমন কথা! তিনি নিজেই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন। প্রথম মহিলা সম্পাদকের হাতে শুরু হল ভারতীর নতুন। অধ্যায়।
.
অন্তরে যাই থাক, জ্যোতিকে বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না, জাহাজের ব্যাবসা নিয়ে এখনও তেমনি মেতে আছেন, বিনোদিনীকে নিয়েও। বসবাস করছেন মূলত জ্ঞানদার বাড়িতে। কাদম্বরীর মৃত্যুতে তাঁর ভূমিকা নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও সংবাদপত্রগুলি ও ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠদের মুখে কুলুপ এঁটে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির সম্ভাবনা চাপা দিয়েছেন দেবেন ঠাকুর। অক্ষয় বা বিহালীলালের কবিতা হয়তো বন্ধ করা যায়নি, রবির একের পর এক শোকগাথার মধ্য থেকেও অনুযোগের সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু সে-সব শিল্পিত প্রতিবাদ উচ্চকোটি সমাজে মৃদু তরঙ্গ তুলেই মিলিয়ে গেছে। রবির বর্ণনামতোই যেমন আছিল আগে তেমনই রয়েছে জ্যোতি।
কাদম্বরীর মৃত্যুর ঠিক একমাসের মধ্যেই খুলনা-বরিশাল যাত্রীফেরি চালানোর সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। ঠিক হল যে ২৩ মে-র শুভদিনে কলকাতার গঙ্গার ঘাট থেকে জাহাজ নিয়ে বরিশালের দিকে যাত্রা করবেন জ্যোতি। রবি আর অক্ষয় তাঁর দুই অবশ্যম্ভাবী সঙ্গী। প্রধান উৎসাহদাত্রী জ্ঞানদা। যদিও এর আগে দু-একটি উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন জ্যোতি, জ্ঞানদার বিশ্বাস এবার তাঁর উজ্জ্বল দেবরটি বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ করবেন।
মনে টানাপোড়েন নিয়েই জ্যোতিদাদাকে সঙ্গ দিতে প্রস্তুত হয়েছেন রবি। জ্যোতির অস্থির প্রকৃতির কারণে ব্যথা পেয়ে চলে গেছেন নতুনবউঠান, কিন্তু সেজন্য দাদার প্রতি রবির ভালবাসা একটুও কমেনি। তীব্র শোককে বুকের গোপন কৌটোয় আটকে রেখে বাইরের সবকাজে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন রবি।
অক্ষয়ের অবস্থাও সেরকম, কাদম্বরীর মৃত্যুর জন্য জ্যোতির ওপর রাগ হয় কিন্তু তাঁকে ত্যাগ করতে পারেন না। আশ্চর্য মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে আছে তাঁদের বন্ধুত্ব।
যিনি চলে গেলেন, তার জন্য কিছুই থেমে থাকল না। ২৩মে-র সকালে বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু হল। সজলনয়নে বউঠান দেবরদের বিদায়ের পটভূমি রচিত হলেও শেষমুহূর্তে তিন যুবকের ওপর ভরসা রাখতে না পেরে জ্ঞানদা সপুত্রকন্যা তাদের সঙ্গী হলেন।
সকালে সবাই সদলবলে চিৎপুর রোড ধরে রওনা হলেন কয়লাঘাটের উদ্দেশে। রাস্তার দুপাশে সারি সারি বেলোয়ারি ঝড়ের দোকান আর ছ্যাকড়া গাড়ির আস্তাবল। রাতের গ্যাসল্যাম্পগুলো নেভানো হয়নি, তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে চোখে ঝিলিক মারছে। একইরকম ধীরগতিতে চলছে। ফাঁকা ট্রাম আর মিউনিসিপালটির ময়লাফেলার গাড়ি। শিককাবাব আর রুটি তৈরি হচ্ছে মুসলমানি খাসির দোকানের ঝোলানো মাংসের পাশেই। কেউ রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে তো কেউ মসজিদের ধারে কোরান পাঠ করছে।
এ-সব পেরিয়ে কয়লাঘাটে পৌঁছে ঘাটের নৌকোগুলোর দিকে তাকিয়ে রবি ভাবলেন এরা যেন অতিকায় দৈত্যদের পায়ের সারি সারি জুতোর মতো দাঁড়িয়ে আছে। অভিজাত নারীপুরুষদের এহেন দলটিকে দেখে মাঝিরা আমার নৌকোয় আমার নৌকোয় আসুন বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কোনওরকমে একটি নৌকোয় চেপে পৌঁছনো হল জাহাজের কাছে।