মৃণালিনীর পরনে কিন্তু শাড়ি নয়, নয়ানশুখ কাপড়ের একটি নীল গাউন পরানো হয়েছে তাকে। গাঁয়ের মেয়েকে চটজলদি ফ্যাশনেবল করে তুলতে চান জ্ঞানদা। কিশোরী জানতে চান, মালিনীদিদি, তোমার কাছে অ্যারিথমেটিক সেকেন্ড বুক আছে গো? আমার তো ফাস্ট বুক শেষ হয়ে গেছে। আর ইউজফুল নলেজ বইটা আছে?
জ্ঞানদা হেসে বললেন, ওদের কাছে কি লোরেটো হৌসের পড়ার বই থাকে রে বোকা মেয়ে, ও আমি তোকে কলেজ স্ট্রিট থেকে আনিয়ে দেব।
রূপা ছিল কাদম্বরীর সবসময়ের সঙ্গী, জ্ঞানদার এই ঠান্ডাভাব তার আর সহ্য হয় না। কাদম্বরীর সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা লড়াইয়ের কথা সে তো ভালই জানে। তবু বিষাদমাখা গলায় সে বলে, মেজোবউঠান, আমি আর বাড়িতে টিকতে পারছি না, তেতলার ঘরের দিকে তাকালেই বুক হু হু করে উঠছে।
জ্ঞানদা বই দেখতে থাকেন নীরবে। রূপা আর মালিনীর জন্য রেকাবিতে জলখাবার নিয়ে আসে একটি কাজের মেয়ে। মৃণালিনী তাড়াতাড়ি অতিথিদের দিকে রেকাবি এগিয়ে দেন।
মালিনী মৌন জ্ঞানদাকে দেখতে দেখতে বলে, নতুনবউঠান কেন এমন করলেন, সেই রহস্যটাই বুঝতে পারলাম না।
রূপা যোগ করে, নিশ্চয় কাছের লোকের কাছে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। অত সাধ করে সাজগোজ করলেন উদ্বোধনে যাবেন বলে—
রূপাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই জ্ঞানদা বলে ওঠেন, না হয় ওকে নিতে আসতে পারেনি নতুনঠাকুরপো, এটুকুতেই আফিম খেয়ে মরতে হবে!
সবাই তো তোমার মতো শক্ত নয়, মেজোবউঠান, রূপা বলে, আর তুমি ভরা সংসার নিয়ে বসবাস কর, রবিদাদা জ্যোতিদাদাকেও তার কাছ থেকে টেনে নিয়েছ, তার দুঃখ তুমি কী বুঝবে?
টেনে নিয়েছি মানে কী রূপা? জ্ঞানদা বিরক্ত হন। কথা যা বলবে, ভেবেচিন্তে বলবে, আমি এরকম মন্তব্য পছন্দ করি না।
হঠাৎ আবহাওয়া কেমন পালটে যাচ্ছে বুঝতে পারেন না মৃণালিনী, তাঁর মুখ থমথমে হয়ে যায় সকলের দিকে তাকিয়ে।
রূপা নাছোড়, জ্যোতিদাদা রাতে এখানে তোমার কাছে থেকে যেতেন বলে তাঁর যন্ত্রণা আমি দিনের পর দিন পাশে থেকে দেখেছি মেজোবউঠান।
মালিনী এবার না বলে পারে না, স্বামী দূরে সরে যাওয়ায় নতুনবউঠান যে দিন দিন নিঃসঙ্গতায় ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন, মেজোবউঠান, তুমি এত বুঝদার আর এটা বোঝনি? তুমিই তো ইচ্ছে করলে জ্যোতিদাদাকে ঠেলে পাঠাতে পারতে তাঁর কাছে।
জ্ঞানদা একটু কোণঠাসা বোধ করেন, তোমরা ঘটনাটার ভুল ব্যাখ্যা করছ মালিনী। কাদম্বরীর স্বভাবেই আত্মহননের বীজ লুকিয়ে ছিল। আর আমার কথা যদি বল, আমি ওকে কোনওদিনই বুঝতে পারিনি। আত্মহত্যা মানে তো হেরে যাওয়া, আমি ভাবতেই পারি না মানুষ কী করে মরে যেতে চায়। নতুনঠাকুরপোকে এর জন্য দায়ী করা ঠিক নয়।
যাকগে মেজোবউঠান, ওকথা থাক, মালিনী বলে, তুমি কি অক্ষয় চৌধুরীর নতুন কবিতা অভিমানিনী নিঝরিণী পড়েছ? আমি পাঠ করছি শোনো–
রাখিতে তাহার মন, প্রতিক্ষণে সযতন
হাসে হাসি কাঁদে কাঁদি মন রেখে যাই
মরমে মরমে ঢাকি তাহারি সম্মান রাখি,
নিজের নিজস্ব ভুলে তারেই ধেয়াই,
কিন্তু সে তো আমা পানে ফিরেও না চায়।
শুনতে শুনতে জ্ঞানদার মুখ থমথমে হয়ে যায়, কবিতাটি তো কাদম্বরীকে নিয়েই লেখা, অধীর হয়ে তিনি বলেন, অক্ষয়বাবুর এ ভারী অন্যায়, কিছুই না জেনে জ্যোতির প্রতি অভিযোগের তির ছুঁড়ে পাঠকের বাহবা কুড়োতে চাইছেন।
উনি বাইরে থেকে যে সত্যিটা দেখতে পেলেন, তুমি ঘরের মানুষ হয়েও দেখলে না মেজোবউঠান, রূপা কথা শোনানোর সুযোগ ছাড়ে না।
জ্ঞানদার ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, আমি যখন ঠাকুরবাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম, তখন পরপুরুষের সামনে বেরোনো যেত না। সেদিনের কথা মনে পড়লে হাসি পায়, তোমাদের মেজদাদার খুব ইচ্ছে হয়েছিল বন্ধু মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে আমার আলাপ করাবেন। কিন্তু আমার তো বাইরে যাওয়ার জো নেই, অন্য পুরুষেরও বাড়ীর ভিতরে আসবার নিয়ম নেই। তাই নিয়ে ওরা দুজনে পরামর্শ করে একদিন বেশী রাত্রে সমানতালে পা ফেলে বাড়ীর ভিতরে এলেন। তারপর উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়সড় হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে বিছানার একপাশে আর তিনি ভোম্বলদাসের মত আর একপাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমানতালে পা ফেলে উনি তাঁকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন। জ্ঞানদার কথায় সবাই হাসতে থাকে।
সুদৃশ্য কাটগ্লাসে ফলের রসে এককে চুমুক দিয়ে জ্ঞানদা বলতে থাকেন, সে দুঃসাহস আমি জুগিয়েছি বলেই কাদম্বরীর নন্দনকাননে এত উপাসক জুটেছিল। অক্ষয়বাবু তো কাদম্বরীর কৃপাদৃষ্টির লোভে কত গান কত কবিতা শোনাতেন ছাদের আসরে। আর ঠাকুরপোর বন্ধু হয়েও তাই এখন তাকে দুষছেন। তোমরা জলখাবার খাচ্ছো না কেন? গ্লাস ও রেকাবি এগিয়ে দেন জ্ঞানদা।
একটুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে মালিনী বলল, তুমি অক্ষয়বাবুর সাক্ষ্য উড়িয়ে দিচ্ছ মেজোবউঠান, তুমি যা দেখতে পাওনি বিহারীলাল সাধের আসনে তার কী বিবরণ লিখেছেন শোনো,
পুরুষ কিম্ভুতমতি চেনে না তোমায়
মন প্রাণ যৌবন– কী দিয়া পাইবে মন।
পশুর মতন এরা নিতুই নতুন চায়।
পশুর মতন! এটা কি বাড়াবাড়ি নয়? জ্ঞানদা বিরক্ত হন, কবিদের কথায় মাঝে মাঝে কোনও লাগাম থাকে না।