শাড়ি-জামা নাড়াচাড়া করেন, চিঠি পড়েন আর অপেক্ষা করতে থাকেন ১৯-এর বিকেলের জন্য। রূপা বাড়ির মেয়েদের ডাকাডাকি করেন কাদম্বরীর সঙ্গে কথা বলতে, সৌদামিনী শরৎকুমারীরা এক-দুবার এসে ঘুরে যান, কিন্তু কাদম্বরীর মৌনতা কেউ ভাঙতে পারেন না।
জাহাজ উদবোধনের একদিন আগেই দেখাশোনার জন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাজে আস্তানা পেতেছেন জ্ঞানদা। জ্যোতি তত তিনদিন ধরে সেখানে আছেনই। এত অতিথির খানাপিনার ব্যবস্থা করা কী চাট্টিখানি কথা! জ্ঞানদা অতিথিদের জন্য বিলিতি মোগলাই সবরকম রান্নার আয়োজন করিয়েছেন। খাবার টেবিল সাজানো, কামরার অন্দরসজ্জা সবদিকেই তার তীক্ষ্ণ নজর। গানবাজনার আয়োজন অবশ্য রবি আর অক্ষয়ের দায়িত্ব। তারাও অনবরত। আসা-যাওয়া করছেন জাহাজে।
একদিকে প্রবল কর্মযজ্ঞ আর অন্যদিকে অনন্ত প্রতীক্ষা। কাদম্বরী ভাবছেন কীভাবে জ্যোতির মুখোমুখি হবেন! কিছু বলবেন, নাকি বলবেন না! ছলনার অভিযোগে জ্যোতিকে কাঠগড়ায় পঁড় করালে তিনিও যদি কাদম্বরীকে বাঁজা অসম্পূর্ণা বলেন! এ-সব চেপে রেখে হাসিমুখে তার সামনে কি দাঁড়াতে পারবেন কাদম্বরী?
জাহাজে তখন শেষমুহূর্তের চাপ। পিয়ানোয় বসে রিড নাড়াচাড়া করতে করতে রবি একবার জানতে চান, জ্যোতিদাদা, নতুনবউঠানকে আনতে যাবে না?
যাব যাব, বলে পিয়ানোয় বসে পড়েন জ্যোতি, একটু পরে যাব, ভাটার টান কমুক। তা তোর বউকে আনছিস না কেন রবি?
সে তো আমি জানি না, তার কথা মেজোবউঠান জানেন, রবি আনমনে উত্তর দিলেন। কাজের লোকেদের ডাকাডাকিতে আবার অন্যদিকে চলে যান জ্যোতি।
কাদম্বরী উদ্বেগে ঘরে-বাইরে করছেন। বিশু তাঁতিনির কাছ থেকে আফিম চেয়ে রেখেছেন, ইচ্ছে-মুক্তি এখন তার হাতের মুঠোয়। একটি সুন্দর হাতির দাঁতের কৌটোয় তুলে রেখেছেন আফিমটা। কিন্তু তার আগে শেষ দেখতে চান তিনি। ১৯ এপ্রিল বিকেলের আগেই কমলা রঙের স্বর্ণচরীতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন হেকেটি ঠাকরুন, এবার সবার মাথা ঘোরানোর পালা। শেষ বাজিটা তাকে জিততেই হবে, ডাকিনী যোগিনীদের হাত থেকে জ্যোতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে নিজের হৃদয়ে। বাঁজা তো কী হয়েছে, নারীত্বের আকর্ষণ তো শেষ হয়ে যায়নি।
কিন্তু জ্যোতি কিছুতেই সময় পাচ্ছেন না জাহাজ ছেড়ে বেরতে। চিরকালের মতোই শেষে রবিকে বললেন কাদম্বরীকে নিয়ে আসতে।
রবি জানেন কাদম্বরী অগ্নিগর্ভ হয়ে আছেন, তিনি সাহস পান না, বলেন, না জ্যোতিদাদা, আজ তোমাকেই যেতে হবে। আজ আমি তাকে সামলাতে পারব না।
কিন্তু জ্যোতি বেরতে গেলেই জ্ঞানদা পিছু ডাকেন, অথবা জাহাজের কাপ্তেন, অথবা কোনও অতিথি আগেভাগেই পৌঁছে গেছেন বলে থেমে যেতে হয়।
কাদম্বরী অপেক্ষা করেন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয়, সন্ধে পেরিয়ে রাত। ছাদ থেকে কে যেন বলে ওঠে, কই লো নতুনবউ, তোর বর নিতে এল না?
এক এক করে সব গয়না খুলে ফেললেন কাদম্বরী। শাড়ি খুলে মেঝেতে ফেলে দিলেন। সাটিনের পেটিকোট আর রেশমি জ্যাকেট পরে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। কারা যেন জানলা দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কী সব বলছে। ঘোরের মধ্যে কাদম্বরী শুনতে পেলেন, জাহাজের নাম রেখেছে সরোজিনী। ওঃ কী অপমান!
অনেক রাতে উঠে হাতির দাঁতের কৌটো খুলে সবটা আফিম মুখের মধ্যে ঢেলে দিলেন কাদম্বরী। তারপর জল খেয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে শুয়ে পড়লেন মেঝেতে।
সকালে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় আবিষ্কার করার পরে শুরু হল যমে মানুষে টানাটানি। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কাদম্বরী, তাঁর পঁচিশ বছরের স্বর্গীয় সৌন্দর্যরাশি যেন ক্রমশ বিষাক্ত আইভিলতার চেহারা নিচ্ছে।
রবি টানা দুদিন তার শয্যার পাশে বসে রইলেন অপরাধী হৃদয়ে। জ্যোতির অবস্থা উদভ্রান্তের মতো। সত্যি সত্যি কাদম্বরী যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে, এটা তার ভাবা উচিত ছিল! সেরেস্তার কাজ বন্ধ। দুই বিখ্যাত ডাক্তার নীলমাধব হালদার ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করেও কিছু করা গেল না।
২১ এপ্রিল ভোরে কাদম্বরী মারা গেলেন।
তার শেষযাত্রায় সঙ্গ নিলেন রবি, সোমেন্দ্র, দ্বিপেন্দ্র ও অরুণেন্দ্র। সারাটা পথ রবি একটিও কথা বললেন না। ফিরে এসেও না। চব্বিশ বছরের জীবনে মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি তিনি। তার সবচেয়ে আপন মানুষটিই অভিমান করে চলে গেলেন, কত কী সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল, কত কথা অকথিত রইল। আর-একটু মনোযোগ দিলে এই বিপত্তি ঘটত না, জ্যোতিদাদা দূরে সরে গিয়েছিলেন বলেও রবির উচিত ছিল আরও কাছে এগিয়ে আসা। এই আপশোস কখনও যাবে না।
মহর্ষির নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হল কাদম্বরীর শেষ চিরকুট, বিনোদিনীর চিঠিপত্র, এমনকী মৃতার হাতের লেখাও। খবরের কাগজে মোটারকম ঘুষ দিয়ে খবর বন্ধ করা হল। এইভাবেই ঠাকুরবাড়ির সুন্দরীতমা, বিষণ্ণতমা নারীটির মৃত্যু ঢাকা পড়ে গেল অনন্ত রহস্যের মোেড়কে।
কিন্তু রবির হৃদয় থেকে তাকে উপড়ে ফেলতে পারলেন না কেউই। কাদম্বরীর প্রথমবারের আত্মহননের চেষ্টার পরে তারকার আত্মহত্যায় রবি লিখেছিলেন, যদি কেহ শুধাইত/আমি জানি কী যে সে কহিত। যতদিন বেঁচে ছিল। আমি জানি কী তারে দহিত। এখন আবার ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা কবিতায় নতুনবউঠানের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করলেন তিনি।
১৯. বিজয়িনী
বিষাদের ভার নিয়ে রূপা আর মালিনী এসেছে জ্ঞানদার কাছে। কিন্তু মেজোবউঠানকে দেখে তাদের আশ্চর্য লাগে, এত ঠান্ডা, দেখে মনেই হচ্ছে না বাড়িতে এত বড় অঘটন ঘটে গেছে। ওদের দেখে কেঁদে ওঠার বদলে তিনি শান্তভাবে মালিনীর ঝুলি থেকে বই বাছতে থাকেন, তাঁর পাশে বই দেখছিলেন বালিকা মৃণালিনী।