- বইয়ের নামঃ কবির বউঠান
- লেখকের নামঃ মল্লিকা সেনগুপ্ত
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. জ্ঞানদানন্দিনী
সন ১৮৬৬। ঠাকুরবাড়ির দেউড়ির সামনে একটি ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। গাড়ির দরজা খুলে মাটিতে নেমে এল বিলিতি জুতো মোজা পরা সুললিত একটি পা, পরে আর-একটি। পায়ের ওপর লুটিয়ে আছে নকশি পাড় মরচেরঙা শাড়ির কুঁচি। তারপর মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন শাড়ি পরা এক ষোড়শী বিদ্যুৎলতা। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে তিনি পা বাড়ালেন বাড়ির অন্দরের দিকে। প্রকাশ্য আঙিনায় চাকর-বেহারাদের চোখের সামনে মেজোবউ জ্ঞানদানন্দিনীর এই অকুণ্ঠ অলজ্জ আবির্ভাবে জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে সেদিন যেন ভূমিকম্প ঘটে গেল। পুরনো চাকরবাকরেরা এই অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। মানদা দাসী অন্দর থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে এমন দৃশ্য দেখে কর্তামাকে খবর দেবার জন্য পড়িমরি ছুট লাগাল। বেজার মুখে নায়েব গোমস্তা পুরুষেরা দাঁড়িয়ে রইলেন। এতদিন পর বোম্বাই থেকে ফিরে মেজোবাবু স্বয়ং যখন বউমাকে পাশে নিয়ে এইভাবে অন্দরে ঢুকলেন, তখন কারও কিছু বলার থাকতে পারে না, বিশেষত কর্তা দেবেন্দ্রনাথ যখন বাড়ি নেই। কিন্তু এহেন সৃষ্টিছাড়া কাহিনির জল যে অনেকদূর গড়াবে তাতে কোনও সন্দেহ রইল না কারওরই।
ঠাকুরবাড়ির মেজোছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বেশ কৃতি ও মেধাবী। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আই সি এস। নারীপ্রগতির বিষয়েও তিনি অতি সক্রিয় চিন্তাভাবনা করতেন। বিয়ের সময় তখনকার নিয়ম অনুসারে সত্যেন্দ্রর নববধূ জ্ঞানদার বয়স ছিল সাত। তাঁর গৌরীদান হয়েছিল। বাপের বাড়িতে সবে তাঁর অক্ষর পরিচয় হয়েছে। নোলক পরা, ঘোমটা টানা সদ্য সাক্ষর সেই বালিকাবধূকে নিয়েই শুরু হল স্ত্রীস্বাধীনতার জন্য সত্যেন্দ্রর লড়াই। উনিশ শতকের বউ-মেয়েদের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে যেভাবে বন্দি করে রাখা হত, সত্যেন্দ্র তরুণ বয়স থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। মা সারদাদেবীকেও তিনি প্রায়ই বলতেন ঘরে বন্দি হয়ে না থেকে বাইরে বেরোতে। রক্ষণশীল সারদা অবশ্য মেজোছেলের এ-সব কথায় গুরুত্ব দেননি, বরং ধমক দিয়ে বলতেন, তুই মেয়েদের নিয়ে মেমেদের মতো গড়ের মাঠে বেড়াতে যাবি নাকি?
কী বা এমন দোষ হয় মেয়েরা গড়ের মাঠে গেলে? সত্যেন্দ্র জানতে চান।
ঘরের শুচিতা নষ্ট হয়। জানিস না, বাড়ির পুরুষেরাও রাতে শোবার সময়ে ছাড়া যখন-তখন অন্দরে ঢুকতে পারেন না! আর সেই বাড়ির মেয়েরা বেটাছেলের সঙ্গে বাইরে গিয়ে হাওয়া খাবে, এমন কাণ্ড কেউ কখনও শুনেছে? লোকে ছি ছি করবে যে!
মা ছেলের এই কথোপকথনের পর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে মা আরও কট্টর হয়েছেন, ছেলে আরও প্রগতিশীল। সেদিনের সেই লজ্জাবতী মেজোবউ বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বেপরোয়া আই সি এস স্বামীর সঙ্গে দু’বছর বোম্বাইতে কাটিয়ে এখন রীতিমতো আলোকিত নারী। কিন্তু সারদাদেবীর গম্ভীর মুখ জ্ঞানদার এই আধা-মেম মূর্তিতে আবির্ভাব দেখে আরও অন্ধকার হল। মেজোছেলে ও মেজোবউ অন্দরে পৌঁছলে কর্তামা অখুশি মুখে তাদের বরণ করতে এলেন। তাকে ঘিরে ঠাকুরবাড়ির চোদ্দো পনেরো জন নানা বয়সের মেয়ে বউ কিশোরী বালিকা। তারা গভীর বিস্ময়ে বোম্বাইয়ের জাহাজে-চড়া বউ দেখতে থাকে। জ্ঞানদার মনেও হিল্লোল ওঠে তাদের জবুথবু ভাবভঙ্গি সাজপোশাকের দিকে তাকিয়ে। এই রূপসি মেয়ে বউদের ব্যক্তিত্ব যেন শাড়ি-গয়নার স্তূপে চাপা পড়ে আছে। কোনও কিশোরীর পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেমন তেমন করে পরা ভারী বেনারসি, কোনও বধূর সোনার অঙ্গ ঢেকে গেছে সোনার গয়নার নির্লজ্জ ঝমঝমানিতে। কিন্তু শাড়ি গয়নার সম্ভারে তাদের উপচে পড়া যৌবন বাধ মানছে না। এই পোশাকে পুরুষের চোখের সামনে সত্যিই বেরনো যায় না।
জ্ঞানদার মনে হল, এজন্যই বোধহয় বাড়ির পুরুষদেরও যখন-তখন অন্দরে আসা বারণ। সারদাসুন্দরীদেবী আগের মতোই বিরাট চৌকির ওপর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসেছেন, চন্দনরঙের মিহি মসলিন শাড়ি যেন তার। গায়ের রঙে মিশে গেছে। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কষামিঠে শস্মৃতি জ্ঞানদার মনে পড়ে যায়। মনের মতো পোষমানা বউ হতে পারেননি বলে তাঁকে শাশুড়ির কাছে নাজেহাল হতে হয়েছে বহুবার। বালিকাবয়সে বউ হয়ে আসার পর শাশুড়ি নিজে সামনে বসে তাঁর পরিচর্যা করাতেন। সারদা বসে থাকতেন চৌকিতে আর তাঁর সামনে দাসীরা বউদের কষে সর-ময়দার রূপটান মাখাত। শ্যামরঙা জ্ঞানদার রোগা চেহারা সারদার পছন্দ হয়নি, তাই তাঁকে রংরূপে ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত করে তোলায় মন দিয়েছিলেন। একবার অন্যবাড়ির কজন মেয়ে-বউ দেখা করতে এল। তাদের রসেবশে চেহারা দেখে সারদা আক্ষেপ করে বললেন, এরা কেমন হৃষ্টপুষ্ট দেখ দেখি, আর তোরা সব যেন বৃষকাষ্ঠ। তারপর কিছুদিন ধরে শুরু হল জ্ঞানদাকে মোটা করার চেষ্টা। নিজ হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে লাগলেন। একমাথা ঘোমটা পরা বালিকাবধূ না পারতেন গিলতে, না ফেলতে। ভাতের দলা নিয়ে সুন্দর চাপার কলির মতো কর্তামার আঙুলগুলি এগিয়ে আসত জ্ঞানদার মুখের দিকে আর বালিকার কেবল মনে হত কখন মা উঠে যাবেন আর তিনি দালানে গিয়ে বমি করবেন।