আরবীয় পয়গম্বর যে “মিশনের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহ সমাধা করিলে পর সেই (দারুণ) সময় আসিল, যখন একদিন (মৃত্যুর কিছুদিন পূৰ্ব্বে) রোগক্লিষ্ট অবস্থায় তিনি বহু কষ্টে নমাজের নিমিত্ত মসজিদে আনীত হইলেন। (নামাজ শেষ হইলে) তিনি আপন পীড়িত ক্ষীণ কণ্ঠ যথাশক্তি উচ্চ করিয়া বলিলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সাধারণে ঘোষণা করিয়া দাও, যদি আমি এ জীবনে কাহারও প্রতি অত্যাচার অবিচার করিয়া থাকি, তবে সে অদ্য আমা হইতে প্ৰতিশোধ লউক, পরলোকের জন্য যেন স্থগিত না রাখে। যদি কাহারও কিছু প্রাপ্য থাকে, সে ঋণ শোধের নিমিত্ত আমার ঘরদ্বার তাহাকে সমর্পণ করিতেছি। অদ্য আমি সকল প্রকার জবাবদিহির জন্য উপস্থিত আছি।”
একজন বলিল, হজরতের নিকট তাহার ত্রিশ “দেরেম’ পাওনা আছে, তাহা রসুলোল্লাহ তম্মমুহূৰ্ত্তে শোধ করিলেন।(7) এই তাঁহার মসজিদে শেষ আগমন। অতঃপর ৬৩২ খৃষ্টাব্দে ৮ই জুন আরবীয় পয়গম্বর নশ্বর মৃন্ময় দেহত্যাগ করলেন, যাহাতে অতি উচ্চ অনন্তধ্যমে গিয়া স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ধর্ম্মের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে পারেন। এই জীবন অতি উচ্চ, পবিত্র বিস্ময়কর এবং বাস্তবিক খোদার পয়গম্ববরেরই যোগ্য ছিল। (অবশ্য, সাধারণ মানবের জীবন এরূপ হওয়া অসম্ভব)।
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আপনাদিগকে আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি যে সব অন্যায় দোষারোপ করা হয়, তাহার বিষয় বলিতেছি। অনভিজ্ঞতা ও ন্যায়ান্যায় জ্ঞানাভাবে, অথবা শুধু কুসংস্কারবশতঃ রসূলের প্রতি ঐসব দোষারোপ করা হইয়া থাকে। তাহার একতম দোষ এই বলা হয় যে, তিনি র শেষভাগে সৰ্ব্বশুদ্ধ ৯জন মহিলার পাণিগ্রহণ করেন। তিনি বিবাহ করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আপনারা কি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারেন যে, সেই ব্যক্তি, যিনি ২৪ বৎসর বয়ঃক্রম পৰ্যন্ত কোন প্রকার “মকারাদি” কু অবগত ছিলেন না, পরে নিজের অপেক্ষা অনেক অধিক বয়স্ক একটি বিধবার পাণিগ্রহণ করিয়া তাঁহারই সহিত অতি সুখে জীবনের ২৬টি বৎসর যাপন করিলেন; তিনি শেষ বয়সে, যখন মানুষের জীব নিৰ্ব্বাপিত প্রায় হয়, শুধু আত্মসুখের জন্যই যে কতকগুলি বিবাহ করিবেন, তাহা কি সম্ভব? যদি ন্যায় বিচারের সহিত বিবেচনা করেন, তবে আপনারা বেশ জানিতে পরিবেন।– সে বিবাহের উদ্দেশ্য কি ছিল। প্ৰথমে দেখিতে হইবে, তাহারা (হিজরতের পত্নিগণ) কোন শ্রেণীর কুলবোলা ছিলেন, আর কেনই বা তাঁহাদের রসুলের প্রয়োজন ছিল।—কতিপয় নারী এরূপ ছিলেন যে তাঁহাদের বিবাহের ফলে রসুলের পক্ষে ‘নূর-ইসলাম’ প্রচারের সুবিধা হইল। আর কয়েকজন। এরূপ ছিলেন যে, বিবাহ ব্যতীত তাহদের ভরণপোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অন্য কোন উপায় ছিল না।
আরবীয় পয়গম্ববরের প্রতি আর একটি দোষারোপ এই করা হয় যে, তিনি রক্তপাতের প্রশ্রয় দিতেন এবং কারণে অকারণে কাফের হত্যা করিতে আদেশ দিতেন। এখন এ সম্পবন্ধে আপনারা আমার বক্তব্য শ্রবণ করুন। যখন আইনের দুই দফা প্রায় একই প্রকার হয় অর্থাৎ একটি কোন সৰ্ত্তের অধীন এবং অপরটি সত্তাবিহীন তখন সৰ্ত্তহীন ধারাও সৰ্ব্বদা সৰ্ত্তাধীন ধারা বলিয়াই মানিতে হয়। মুসলমানদের শাস্ত্রকারগণ সৰ্ব্বদা এ বিষয়ের সম্মান রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন এবং কোরআনের বচনসমূহেও একথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যথা একস্থলে বলা হইয়াছে, “কাফেরকে হত্যা কর,” এবং অপর স্থলে বলা হইয়াছে, “হত্যা কর, যদি তাহারা তোমাদের ধৰ্ম্মকর্ম্মে বাধা দেয়।” এখন আমি আপনাদিগকে সেই মূল্যবচনসমূহের-যাহা রসূলের প্রতি প্রত্যাদেশ হইয়াছে, শাব্দিক অনুবাদ শুনাইতেছি। আমি নিজের ভাষায় বলিব না, কারণ যদি আপনারা মনে করেন যে আমি তাহাদের (মুসলমানদের) ধৰ্ম্মপ্রচার করিতেছি। তবে শ্রবণ করুন :
“যদি তাহারা তোমাদের প্রতি শত্রুতচরণ হইতে নিবৃত্ত হয়, তবে যাহা হইয়া গিয়াছে, ক্ষমা করা যাউক। কিন্তু যদি তাহারা তোমাদিগকে আক্রমণ করিতে অগ্রসর হয়, তবে পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী পয়গম্বরদের প্রতি বিরুদ্ধাচরণের নিমিত্ত যেরূপ শাস্তি দেওয়া গিয়াছে সেইরূপ শাস্তি ভোগ করবে। এজন্য উহাদের সহিত যুদ্ধ করা যে পৰ্যন্ত উহারা পৌত্তলিকতা রক্ষার নিমিত্ত তোমাদের বিরুদ্ধাচরণে নিবৃত্ত না হয় এবং অদ্বিতীয় খোদার ধৰ্ম্মকে অমান্য করে, যুদ্ধ করিতে থাকে। আর যদি তাহারা মানে তবে নিশ্চয় জানিও আল্লাহ তাহদের কার্য্যকলাপ পৰ্য্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু যদি তাহারা সত্যাধর্ম্মের বিরোধী হয় তবে আল্লাহ তোমাদের সহায় হইবেন। তিনি সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ অভিভাবক এবং সাহায্যকৰ্ত্তা।”
আর একটি বিষয়, যাহা পয়গম্বরকে উপদেশ দানের নিমিত্ত কোরআনে অবতীর্ণ হইয়াছে, আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি :
“মনুষ্যদিগকে নাম মৃদু ভাষায় যুক্তি সহকারে উপদেশ দিয়া আল্লাহতালার ধৰ্ম্মপথে আহবান করা; তাহদের সহিত অতিশয় ধৈৰ্য্য, ও গান্তীৰ্য্যের সহিত সদয়ভাবে তর্ক কর, কেন না। উহাদের কে সত্য পথ ভুলিয়া ভ্রান্ত হইয়াছে এবং কে সত্যপথে আছে তাহা আল্লাহ সবিশেষ অবগত আছেন। যদি তুমি প্রতিশোধ লও। তবে লক্ষ্য রাখিও যে তাঁহা তোমার প্রতি যে অত্যাচার অনাচার হইয়াছে (ন্যায় বিচার অনুসারে) তাহার সমান হয়; আর যদি তুমি প্রতিশোধ না লইয়া সহ্য কর তবে সাবের (সহিষ্ণু) ব্যক্তির পক্ষে আরও ভাল কথা। সুতরাং ভাল হয় যদি শক্ৰদের প্রপীড়ন ধীরতার সহিত সহ্য কর। কিন্তু স্পমরণ রাখিও তোমার কাৰ্যকলাপ তবেই সফল হইবে, যখন তাহার সহিত আল্লাহতালার অনুগ্রহ মিশ্রিত থাকিবে। কাফেরদের ব্যবহারে দুঃখিত হইও না, এবং উহাদের চাতুরী শঠতায়ও ব্যতিব্যস্ত হইও না, কারণ আল্লাহ তাহারেই সাহায্য করেন—যাহারা সাধু ও ন্যায়পরায়ণ হয় এবং তাহাকে ভয় করে।”