“জগৎপাতা! তুমি সমস্তই দেখিতেছি, এবং সবিশেষ অবগত আছ। অদ্য যদি আমার ক্ষুদ্র সেনাদল বিনষ্ট হইয়া যায়, তবে তােমার সত্য নাম প্রচার করিবার লোক আর কেহ থাকিবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তুমি সত্যের সহায় হইবে।”
অবশেষে এই প্রথম রক্ত প্রবাহিনী যুদ্ধ-যাহা বন্দরের যুদ্ধ নামে বিখ্যাত—হইয়া গেল। ওদিকে ত সহস্ৰ সহস্ৰ যোদ্ধা ধরাশায়ী হইল, এদিকে একশত বীরও ক্ষয় হইয়াছিল কি না। সন্দেহ। কাৰ্য্যতঃ ইহা সুস্পষ্টই বোধ হইতেছিল যে, মুসলমানদের পক্ষে কোন অদৃশ্য শক্তি যুদ্ধ করিতেছিল, তাই স্বল্প সময়ের মধ্যেই মোসলেমগণ সম্পূর্ণ জয়লাভ করিলেন। পয়গম্বর সাহেবের জীবনে এই প্রথম রক্তপাত-যাহা তিনি অনন্যোপায় হইয়া করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নতুবা তিনি এমন দয়ার্দ্রহৃদয় ও বিশ্বপ্রেমিক ছিলেন যে, দুৰ্দ্ধৰ্ষ লোকেরা তাঁহাকে ভীরু ও কাপুরুষ বলিত। এইরূপে কয়েকরার আরবের মোসলেম-বিদ্বেষিগণ মহা সমারোহে যুদ্ধায়োজন লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করে, এবং পয়গম্বর সাহেব শুধু আত্মরক্ষাশিষ্যমণ্ডলীর প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত যুদ্ধ করিতে বাধ্য হন। পরস্তু সৰ্ব্বদা সত্য ও ঈশ্বরের অনুগ্রহ তাহার সঙ্গে থাকায় বিজয়ের উপর বিজয় লাভ করিতে থাকিলেন। এবং অযাচিত প্রভুত্ব লাভ করিলেন। এমনকি তিনি স্বাধীন রাজার ন্যায় সমগ্র আরব উপদ্বীপে রাজত্ব করিতে লাগিলেন।
এই সময় পয়গম্বরের অতীত ও বৰ্ত্তমান জীবনে বিশেষ পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হইল। পূৰ্ব্বে লোকে তাহার প্রতি অত্যাচার করিলে তিনি তাহার প্রতিশোধ না লইয়া তাহাদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করিতেন। এখন তিনি সৈন্য সেনানী ও যথাবিধি সমর্যায়োজন রাখিতে বাধ্য হইলেন-যাহা একজন সম্রাটকে করিতে হয়। এবং অপরাধীকে শাস্তিদান করিতেও হইত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তিনি অতি উচ্চ আদর্শের দয়া ও ন্যায় বিচার প্রদর্শন করিয়াছেন।
পয়গম্বর সাহেবের জন্মের পূর্বের অর্থাৎ যে সময়কে আরবীয় মুসলমানদের মূর্খতার যুগ বলা হয়, যুদ্ধে ধৃত বন্দীগণের প্রতি এমন নৃশংস নিৰ্য্যাতন করা হইত যে, তাহার তুলনা নিতান্ত অসভ্য বৰ্ব্বর জাতির মধ্যেও পাওয়া কঠিন। কিন্তু পয়গম্বর সাহেবের সময়ে যুদ্ধে ধৃত বন্দীদিগের প্রতি যেরূপ সদয়, সুভদ্র ব্যবহার করা হইত, তাহার আদর্শ অদ্যপি কোন অতি সভ্য দেশ ও সমাজে পাওয়া যাইবে কি না, সন্দেহ। একদা রণযাত্রাকালে তাঁহাদের সমভিব্যাহারে এক দল বন্দী ছিল। খাদ্য সামগ্ৰীতে (রাসাদে) আটা অল্প ছিল বলিয়া সংবাদ পাওয়া গেল; তচ্ছবিনে রসুলোল্লাহ আদেশ দিলেন যে, বন্দীদিগকে রুটী দান করা হউক, আর স্বাধীনেরা খৰ্জ্জুর ভক্ষণ করুক। (কি মহত্ত্ব!)
আর এক বারের ঘটনা এই যে, যুদ্ধ জয়ের পর, লুষ্ঠিত দ্রব্য যখন বণ্টন করা হইল, তখন পয়গম্বর সাহেব স্বীয় নিকটবৰ্ত্তী প্রিয় সহচরবৃন্দকে ভাগ লইতে দিলেন না। ইহাতে তাহারা ক্ষুব্ধ হইয়া পরস্পর আলোচনা করিতে লাগিলেন। পয়গম্বর সাহেব তাহা অবগত হইয়া, সহচরদের ডাকিয়া বলিলেন, “বন্ধুগণ! তোমরা জান, পূৰ্ব্বে তোমরা কিরূপ বিপন্ন ছিলে, আল্লাহ তোমাদের বিপন্মুক্ত করিয়াছেন; তোমরা একে অপরের রক্ত পিপাসু ছিলে, প্ৰভু তোমাদিগকে এখন ভ্রাতৃপ্রেম দান করিয়াছেন; তোমরা কোফরের (অধৰ্ম্মেীর) অন্ধকারে কারারুদ্ধ ছিলে, তিনি বিশ্বাসের নিম্পর্মল জ্যোতিতে তোমাদের মন আলোকিত করিয়াছেন। তাহার এই সকল অনুগ্রহপূরস্কার কি তোমরা প্রাপ্ত হও নাই?” তাহারা এক বাক্যে বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ আমাদের অবস্থা বাস্তবিক এইরূপই ছিল, এবং এখন যে সুখ সম্পদ ভোগ করিতেছি, আল্লাহতালারই অনুগ্রহে এবং আপনার দয়ায় আমাদের ভাগ্যে ঘটিয়াছে।” তিনি উহাদের কথায় বাধা দিয়া বলিলেন, “না, নাং বল যে কেবল খোদার অনুকম্প ছিল। আর যদি তোমরা এইরূপ বলিতে ত’ আমিও সাক্ষ্য দিতাম। আমার সম্বন্ধে তোমরা ইহা বলিতে পার যে, তুমি এখানে পলায়ন করিয়া আসিয়াছ, আমরা তোমায় আশ্রয় দিয়াছি; তুমি দুঃখচিন্তা ভারাক্রান্ত ছিলে, আমরা তোমায় সাত্ত্বনা দিয়াছি।” (এ কথায় তাহারা কোন উত্তর দিলেন না। তাঁহাদিগকে মৌনাবলম্বন করিতে দেখিয়া) পুনরায় পয়গম্বর সাহেব বলিলেন, “হে প্রিয় সহচরবৃন্দা! লুষ্ঠিত দ্রব্যের বিনিময়ে কি তোমরা আমাকে পাইতে ইচ্ছা কর না? খোদার কসম! খোদার সমস্ত রাজ্য বিপক্ষে দাড়াইলেও মোহাম্মদ আপনি সহচরদের পক্ষে থাকিবে, যে হেতু তাঁহারা বিনা স্বার্থে-শুধু ঈশ্বরোদেশে কষ্ট স্বীকার করিতেছেন।”
পয়গম্বর সাহেবের এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার সুফল এমন হইল যে, উক্ত সহচরীগণর্যাহারা মরিতে মারিতে নিভীক, শৌৰ্য বীৰ্য্যে সিংহ-তুল্য জাতি ছিলেন, এক্ষণে দর বিগলিত ধারায় অশ্রু বিসৰ্জন করিতে লাগিলেন এবং বলিলেন, “হে রসুলাল্লাহু! আমাদের বাৰ্ত্তমান। অবস্থায় সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হইয়াছি।”
আমার হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা বাস্তবিক আরবীয় পয়গম্বরের অবস্থা কিছুমাত্র অবগত নহেন। আপনারা এ অলৌকিক ঐশিক শক্তি দেখিতে সক্ষম নহেন, যাহা তাঁহার সহস্ৰ সহস্র শিষ্যকে কষ্ট স্বীকার তা তুচ্ছ—মৃত্যুর সম্পমুখীন করিয়াছে; যাহা কোটী কোটী লোকের অন্তরে ঈশ্বর প্ৰেম অঙ্কিত করিয়াছে আপনারা আরবীয় পয়গম্ববরের নিরহঙ্কার ভাবও আত্মত্যাগের বিষয় একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন ত! তিনি অনুবৰ্ত্তিগণকে এই শিক্ষাই দিয়াছেন যে তাঁহাকে যেন কেহ দেবতা কিম্বাবা অমাধারণ ব্যক্তি বলিয়া জ্ঞান না করে। তিনি বার স্বার বলিয়াছেন, “আমি তোমাদেরই মত মানুষ, এইমাত্র প্রভেদ যে, আমি তাহার (খোদার) দূত, তাহার সংবাদ তোমাদিগকে পেঁৗছাই।” পয়গম্বর সাহেবের নিরভিমান ও সরলতার প্রমাণ এতদপেক্ষা অধিক আর কি হইতে পারে। যে সময় তিনি রাজাধিরাজ সম্রাট ছিলেন, তখন স্বহস্তে আপন জীর্ণবস্ত্রে চীর সংলগ্ন করিতেন-ছিন্ন পাদুকা স্বহস্তে সেলাই করিতেন! তাহার শান্ত স্বভাব সম্বন্ধে তদীয় ভূত্য আনাস বলিয়াছেন, “আমি দশ বৎসর তাঁহার নিকট ছিলাম, তিনি কদাচ অপ্রিয় বচন কহিবেন দূরে থাকুক, আমার ‘তুই’ পর্য্যন্ত বলেন নাই।” (হাদীস শরীফে তুই শব্দের উল্লেখ নাই), ভ্রাতৃগণ! এমনই আড়ম্বর-শূন্য জীবন ছিল সেই সম্রাটের, যিনি ইচ্ছা করিলে পরিচর্য্যার জন্য সহস্রাধিক দাস দাসী রাখিতে পারিতেন!