“রসুলের নিকট এক অন্ধ আসিল, কিন্তু সে (রাসুল) অবজ্ঞা করিল ও তাহার কথায় ভ্ৰক্ষেপ করিল না। তুমি কি করিয়া জান যে, সে পাপমুক্ত হইবে না, উপদেশ গ্রহণ করিবে না এবং সেই উপদেশ সে উপকৃত হইবে না? যে ব্যক্তি ধনী, তাহার সহিতই তুমি সসম্প্রম সম্ভাষণ করিতেছ, যদ্যপি সে বিশ্বাসী (ইমানদার) না হইত, তজ্জন্য তুমি অপরাধী হইতে না। কিন্তু যে ব্যক্তি স্বয়ং সরল হৃদয়ে সত্য ও মুক্তির অন্বেষণে আসিল, তাহার প্রতি মনোযোগ করিলে না। (ভবিষ্যতে যেন আর কখনও এরূপ না হয়)।”
ঐ দৈবা।দেশ পয়গম্বর সাহেবের মনে অত্যন্ত ফলপ্ৰদ হইয়াছিল। তদবধি যখনই তিনি উক্ত অন্ধকে দেখিতেন, তখনই বলিতেন, ইহার আগমন শুভ। যেহেতু ইহারই উপলক্ষে আল্লাহ আমাকে শাসন করিয়াছেন। পয়গম্বর সাহেব উক্ত অন্ধকে অত্যন্ত আদর যত্ন করিতেন এবং দুইবার তাহাকে মদিনায় কোন উচ্চপদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। ফল কথা এই যে, পয়গম্বর সাহেব কেবল অপরকেই উপদেশ দিতেন না, বরং নিজের আত্মাকে উপদেশ গ্রহণের নিমিত্ত সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক প্ৰস্তুত রাখিতেন।
সচরাচর যেরূপ প্ৰত্যেক পয়গম্পবরের সহিত হইয়া আসিয়াছে, সেইরূপ আরবীয় পয়গম্বরের বিরুদ্ধেও সাধারণের বৈরিতারূপ ঝঞ্চানিল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত শক্ৰতা সাধনের নিমিত্ত পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যমণ্ডলীর বিরুদ্ধে নূতন বিপদের সূত্রপাত হইতে লাগিল! অবশেষে অবস্থা এমন ভীষণ হইয়া দাড়াইল যে পয়গম্বর সাহেব সমুদয় মুসলমানকে আপন আপন প্ৰাণ লইয়া যত্রতত্র পলায়ন করিতে অনুমতি দিলেন। তখন হজরতের নিকট মাত্র একজন ব্যতীত আর কেহই রহিল না। কিন্তু পয়গম্পবর সাহেব স্বীয় কৰ্ত্তব্য তেমনই নিভীক চিত্তে পালন করিতে থাকিলেন। এই সঙ্কট সময়ে তাহার আরিকুল তাহার প্রাণ বিনাশের সুযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিল। তাহার পিতৃব্য আবুতালেব আর সাহা করিতে না পারিয়া তাহাকে ডাকিয়া সয়েহে বলিলেন, “হে পিতৃব্য-প্ৰাণ! কথা শুন, অমূল্য প্রাণ এমন অবহেলায় হারাইস না। আরবের রক্ত পিপাসু খঞ্জরাসমূহ তোরই জন্য শাণিত হইতেছে! তুই নিবৃত্ত হ’, তোর বক্তৃতা বন্ধ কর।”
তাঁহার কথায় পয়গম্বর সাহেব অতি সাহসের সহিত যে উত্তর দিয়াছিলেন, তাহা চিন্তা করিবার উপযুক্ত বটে। তিনি বলিলেন :
“পিতৃব্যদেব! আমি নিরুপায়। আমি ত কিছুই করি না, কে যেন আমার দ্বারা করাইতেছে। যদি বিধৰ্ম্মীগণ আমাকে এক হস্তে সূৰ্য্য অপর হস্তে চন্দ্র দান করিয়া বলে, “তুমি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ কর, তবু নিশ্চয় জানিবেন, আমি এ কার্য হইতে বিরত হইব নাযে পৰ্য্যন্ত ঈশ্বরের সেরূপ ইচ্ছা না হয়। অথবা আমি আমার এই সাধনার নিমিত্ত প্ৰাণত্যাগ করিব। তবে যদি আপনি নিজের জন্য ভয় করেন ত বলুন, আমি এই মুহূৰ্ত্তে আপনাকে ছাড়িয়া অন্যত্র যাই—আমার আল্লাহ আমার সঙ্গে থাকিবেন।” এই বলিয়া পয়গম্বর সাহেব সাশ্রুনিয়নে গমনোদ্যত হইলেন।
কিন্তু পিতৃব্যের স্নেহের উৎস উথলিয়া উঠিল, তিনি ব্যস্তভাবে বলিলেন, “প্ৰাণাধিক! আমি তোকে কিছুতেই ছাড়িব না। তোর অরিকুল হইতে তোকে রক্ষা করিব। তুই নিৰ্ভয়ে আপন কাজ কর।”
কিন্তু ভদ্ৰ মহোদয়গণ! আরবীয় পয়গম্বরের এই স্নেহময় পিতৃব্য আর অধিক দিন তাহার সঙ্গে থাকিতে পারেন নাই। সেই ঘোর দুর্দিনে তিনি দেহত্যাগ করিলেন। আর এই বৎসরই তাহার পতিপ্ৰাণা বনিতা খাদিজা বিবিও প্ৰেম-পাশ ছিন্ন করিয়া অনন্ত ধামে প্ৰস্থান করিলেন। এই সময় বাস্তবিক পয়গম্পর্বর সাহেবের পক্ষে অতি কঠোর শোক ও বিপদাকীর্ণ পরীক্ষার সময় ছিল। রসূলের শত্রুপক্ষ এই সময় প্রবল হইতে প্রবলতর হইল। (আহা! বিপদ কখনও একা আইসে না)।
ক্রমে অবস্থা এমন ভয়ানক হইল যে, পয়গম্বর সাহেব মক্কা পরিত্যাগ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। তখন হজরত আলী এবং আবুবকর সিদীক-মাত্র এই দুইজন ব্যতীত, তাহার নিকট আর কেহই ছিল না। তমোময়ী নিশীথে পয়গম্বর সাহেব ত আবুবকরকে সঙ্গে লইয়া মদিনা অভিমুখে যাত্রা করিলেন, এদিকে হজরত আলী তাঁহার শয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন যাহাতে শত্ৰুগণ নিশ্চিন্ত থাকে। মোহাম্মদ সাহেবের অরাতিকুল যথাকলে উন্মুক্ত কৃপাণ হস্তে তথায় উপস্থিত হইল; বস্ত্রাবরণ উন্মোচন করিয়া দেখিল, একি! এ ত মোহাম্মদ (দঃ) নহেন! এ যে আলী শয়ান রহিয়াছেন! উহারা তাহাকে কিছু না বলিয়া পয়গম্বর সাহেবের মস্তক আনয়নের নিমিত্ত বহুমূল্য পুরস্কার ঘোষণা করিল।
পয়গম্বর সাহেব যৎকালে একমাত্র সঙ্গী আবুবকর সিদীক সহ গমন করিতেছিলেন, তখন আবুবকর অত্যন্ত ব্যাকুল চিত্তে কহিলেন, “হে হজরত! আমরা ত মাত্র দুইজন!” তিনি উত্তর করিলেন, “না, না! আমরা তিন জন-ইহাদের একজন অতিশয় প্রতাপশালী— সমুদয় বিশ্বজগৎ এক দিকে, আর তিনি একা এক দিকে।” আবুবকর সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন, “হজরত! সে তৃতীয় জন দ্বারা আপনি কাহাকে বুঝাইতে চাহেন? ” উত্তর হইল, “সেই সৰ্ব্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের নিমিত্ত সঙ্গে আছেন।” এ কথায় আবুবকর নিশ্চিন্ত হইলেন।
পয়গম্বর সাহেব মদিনা নগরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে তিনি আশাতীত যত্ন ও সমাদরে গৃহীত হইলেন। শত শত সমাজ-নেতা অগ্রসর হইয়া, তাহাকে আমন্ত্ৰণ করিয়া লাইতে আসিলেন, এবং তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। হজরতের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অনুচরবর্গও ক্রমে ক্ৰমে মদিনায় আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু পয়গম্বরের বিপক্ষগণ সেখানেও তাঁহাকে নিশ্চিন্ত মনে তিষ্ঠিতে দিল না। তাহারা এবার সৈন্য সামন্ত সংগ্ৰহ করিয়া পয়গম্বর সাহেবকে আক্রমণ করিল। তখন পয়গম্বর সাহেবও কেবল আত্মরক্ষা কলেম্প স্বীয় ক্ষুদ্র যোদ্ধৃদল লইয়া বাহিরে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা করিলেন :