ঈদৃশ উত্তর শ্রবণে পিতার অসন্তুষ্টি হইবারই সম্ভাবনা ছিল; কিন্তু তাহা তো হইল না! বরং তিনি বলিলেন, “পিতৃ-প্ৰাণ-পুত্তলি! আমি তোমাকে অতিশয় সন্তুষ্ট চিত্তে তাহার শিষ্যত্ব গ্রহণ ও তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে অনুমতি দিতেছি। যেহেতু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি তোমাকে সুপথ ছাড়া কুপথে পরিচালিত করিবেন না।”
নবুয়তের (পয়গম্বরী প্রাপ্তির) তিন বৎসর পর্যন্ত পয়গম্বর সাহেব নীরবে, বিনা আড়ম্ববরে আপনি মিশনের কার্য্য করিতেছিলেন। সে সময় তাহার প্রতি বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন ছিল। অতঃপর তিনি প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা করিলেন, তাহাতে আল্লাহতালার একত্বের বিষয় অতি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় বর্ণনা করিয়াছিলেন, এবং নরবলিদান, বিলাসিত ও সুরাপান যে অতি কদৰ্য্য, তাহাও বিশদরূপে বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন। তাহার ঐ বক্ততার গুণে অনেকের হৃদয়ে বিশ্বাসের জ্যোতি প্ৰদীপ্ত হইল এবং তাঁহার শিষ্য সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। কিন্তু ইহার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবন্ধকতা-বহ্নিও পয়গম্বর সাহেবের বিরূদ্ধে দেশময় প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল। বিরোধী দলের হস্তে পয়গম্বর সাহেব যত প্রকার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও নিগ্ৰহ ভোগ করেন, সাধারণ মানব তাহা কিছুতেই সহ্য করিতে পারিত না।
বিধর্ম্মী শত্ৰুগণ পয়গম্ববর সাহেবের ভক্ত, বিশ্বাসী লোককে যখন যেখানে দেখিতে পাইত, তমুহূৰ্ত্তেই হত্যা করিত। কাহারও প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করিত। কাহাকে বা হস্ত পদ শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া সূৰ্য্যের দিকে মুখ করিয়া মরুভূমিতে উত্তপ্ত বালুকার ড্রপরে শয়ান করাইয়া তাঁহার বক্ষের উপর প্রস্তর চাপা দিয়া বলিত, “তুই মোহাম্মদ ও তাহার আল্লাহকে অস্বীকার কর।” কিন্তু এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও তাঁহারা মোহাম্মদের কলেমা পড়িতে পড়িতে অকাতরে প্রাণত্যাগ করিতেন!
একদা কোন দুরাত্মা জনৈক মুসলমানকে ধরিয়া তাহার দেহ হইতে খণ্ড খণ্ড মাংস কাটিয়া ফেলিতেছিল, আর বলিতেছিল, “এ তুই যদি নিজের পুত্র পরিবারের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে ঘরে থাকিতিস, আর তোর স্থলে তোর মোহাম্মদ এইরূপ ছিন্নদেহে ভূমে লুটাইয়া ছট্ফট্ করিত তবেই বেশ ভাল হইত!” কিন্তু সেই সত্য ধৰ্ম্মপ্রাণ মুসলমান মৃত্যু পর্যন্ত এই একই উত্তর দিতেছিলেন, “আমার গৃহ, পুত্র কলাত্র-সুখ স্বাচ্ছদ্য, সমুদয় হজরৎ রসুলের পদতলে উৎসর্গ হউক। আমার সম্মুখে যেন তাহার চরণ কমলে একটি কন্টকও বিদ্ধ না হয়।”(6)
অবশেষে বিরোধী শত্ৰুগণ পয়গম্বর সাহেব ও তদীয় শিষ্যবৰ্গকে এত অধিক ক্লেশ দিতে লাগিল যে, তাহারা শেষে রসূলের ইঙ্গিতে দেশান্তরে গিয়া আশ্ৰয় লইতে বাধ্য হইলেন। পয়গম্বর সাহেবের একদল যখন শত্রু-তাড়নায় ব্যস্ত হইয়া হাবশ (আবিসিনীয়া) দেশে গেলেন, তখন শক্রিগণও তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সে দেশে উপস্থিত হইল, এবং তত্ৰত্য খ্ৰীষ্টান রাজাকে অনুরোধ করিল যে, গকে উহাদের হন্তে সমর্পণ করা হউক। রাজা তখন হতভাগ্য প্রবাসী দিগকে ডাকিয়া তাহদের অবস্থা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহারা বলিলেন, “রাজন! আমরা অজ্ঞতা ও মূর্খতার সমুদ্র নিমগ্ন ছিলাম, আমরা ঘূণিত পৌত্তলিক ছিলাম; আমাদের জীবন দুৰ্দান্ত পশুপ্রকৃতি নরপিশাচের ন্যয় নীচ ও জঘন্য ছিল; নরহত্যা আমাদের দৈনন্দিন ক্রীড়া ছিল; আমরা জ্ঞানান্ধ, ঈশ্বরদ্রোহী ও ধৰ্ম্মজ্ঞান বিবজ্জিত ছিলাম; পরস্পরের প্রতি স্নেহশ্ৰীতি বা মনুষ্যত্বের নামগন্ধ আমাদের মধ্যে ছিল না; অতিথি সেবা কিম্বা প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালন বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম; আমরা ‘জোর যার মুলুক তার ব্যতীত অন্য বিধিনিয়ম জানিতাম না। আমাদের ঐই ঘোর দুরবস্থার সময় আল্লাহুতালা আমাদের মধ্যে এমন একজন মানুষ সৃষ্টি করিলেন-যাহার সত্যতা, সাধুতা এবং সরলতার উজ্জ্বল চিত্র আমাদের হৃদয়পটে অঙ্কিত রহিয়াছে; সেই ব্যক্তি আমাদিগকে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, “আল্লাহ এক, সৰ্ব্ব কলঙ্ক হইতে পবিত্র, কেবল তাঁহারই উপাসনা করা আমাদের অবশ্য কৰ্ত্তব্য; আমাদিগকে সত্য অবলম্বন এবং মিথ্যা বর্জন করিতে হইবে; প্রতিজ্ঞা পালনে বিশ্বজগতের প্রাণিবৃন্দের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শনে, প্রতিবেশীর প্রতি কৰ্ত্তব্য পালনে যেন বিমুখ না হই; যেন স্ত্রীজাতির প্রতি সদ্ব্যবহার করি, পিতৃহীনের সম্পত্তি আত্মসাৎ না করি; নিয়ম মত দৈনিক উপাসনা ও উপবাস (রোজা) ব্ৰত পালনে অবহেলা না করি।” রাজন! আমরা এই ধৰ্ম্মে বিশ্বাস রাখি এবং এই শিক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছি।”
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! পয়গম্বর সাহেবের শিষ্যবর্গের বিশ্বাস এবং ধৰ্ম্মমত এমনই উচ্চ ছিল যে, তাহারা প্ৰাণ হেন প্রিয় বস্তু করতলে লইয়া বেড়াইতেন! আমি আরবীয় পয়গম্ববরের সত্যতা ও অকপট হৃদয়ের প্রমাণ স্বরূপ আর একটি বিষয় আপনাদের শ্রবণগোচর করিতেছি।
একদা পয়গম্বর সাহেব আরবের কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, এমন সময় একজন অন্ধ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “হে খোদার রসূল! আমাকে পথ দেখাইয়া দাও, আমি সত্য পথ লাভ করিবার আশায় আসিয়াছি।” পয়গম্বর সাহেব বাক্যালাপে অন্যমনস্ক থাকাবশতঃ তাহার উক্তি শ্রবণ করেন নাই। সে পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিল, “হে রসুলোল্লাহু! আমার কথা শুন, ধৰ্ম্মপথ দেখাও!” তদুত্তরে তিনি কিঞ্চিৎ বিরক্তির সহিত তাহাকে অপেক্ষা করিতে ইঙ্গিত করিলেন। কিন্তু ইহাতে সে অন্ধ ক্ষুন্নচিত্তে চলিয়া গেল। পর দিবস পয়গম্বরের প্রতি যে “অহি” (দৈবাদেশ) আসিয়াছিল, যাহা অদ্যপি কোরআনে লিপিবদ্ধ আছে এবং চিরকাল থাকিবে, তাহার মৰ্ম্ম এই: