সেই পুণ্যবতী মহিলা, যিনি সৰ্ব্ব প্রথমে পয়গম্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন,— এমনই সঞ্জীবনীসুধা পূর্ণ প্ৰবোধ বাক্যে র্তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন যে তিনি-যিনি নিজের দুর্বলতায় জড়ীভূত ও নিরুদ্যম হইয়া সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করিয়া বসিয়া ছিলেন,(3) এখন পূর্ণ সাহসে ও উৎসাহপূর্ণ হৃদয়ে, একেবারে উঠিয়া দাড়াইলেন! আর সে মোহাম্মদ কেবল মোহাম্পমদ মাত্রই রহিলেন না-বরং প্রবল প্ৰতাপশালী পয়গম্বর হইয়া গেলেন। তিনি একটা অসভ্য, অরাজক দেশকে শান্তিপূর্ণ এবং একটা জনপ্রাণীবিরল নগণ্য উপদীপকে এক মহা সাম্রাজ্যে পরিণত করিয়া তুলিলেন। তাহার শিষ্যমণ্ডলী ইউরোপে ধৰ্ম্ম ও জ্ঞানের আলোক লইয়া গেলেন, এই দুইটী বস্তু সেখানে প্রায় ছিলই না। তাঁহার অনুবৰ্ত্তিগণ পৃথিবীতে বড় বড় সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থান করিলেন। তাহারা সমবিশ্বাসীগণ এমন নিষ্ঠার সহিত এলাহীর ধ্যান ও স্মরণে নিমগ্ন হইলেন যে, তাহার আদর্শ অন্য কোন ধৰ্ম্মে পাওয়া সম্ভবপর কি না সন্দেহ। কারণ আপনারা একটু চিন্তা করিলে এবং ন্যায়চক্ষে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাইবেন যে, অন্য কোন ধৰ্ম্ম এমন নাই, যাহাতে এমন অকপটহাদয় সত্যবিশ্বাসী লোক পাওয়া যায়। এই জ্ঞান বিশ্বাস তাহারা (মুসলমানেরা) আরবদের পয়গম্বর হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে।
যদি বেন সাহেবের কথামত ইহাই সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় যে, সাধারণ আচার ব্যবহার হইতে ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহা হইলে আপনারা ঐ ধর্ম্মের অনুবৰ্ত্তিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন এবং ভাবিয়া দেখুন, তাহার (হজরতের) বাক্যসমূহ তাঁহার শিষ্যবর্গের হৃদয়ে কেমন স্পষ্টভাবে অঙ্কিত রহিয়াছে। মুসলমানেরা আরবের পয়গম্বর হইতে যে শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে তাহাদের বিশ্বাস এমন সুদৃঢ় যে, তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ স্থান পায় না।
একজন মুসলমান-যদ্যপি এমন কোন স্থানে এমন কতকগুলি লোক দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, যাহারা তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ছুরিকায় খণ্ড খণ্ড করে এবং তাহার পরগাস্বরের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে—নমাজে মস্তক অবনত করিতে কিছুমাত্র লজ্জিত বা কুষ্ঠিত হয় না।(4)
আপনারা আরও একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন, পয়গম্বরের সুপারিশের (শাফাআতের) প্রতি তাহাদের বিশ্বাস কেমন অটল যে, তাহারা মৃত্যুভয় একেবারে জয় করিয়া ফেলিয়াছে। আফ্রিকার দরবেশবৃন্দের সৎসাহসের তুলনা কেহ আমাকে দেখাইতে পারেন কি?-র্যাহারা ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু তোপ-কামানের সম্পমূখে স্থিরভাবে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাড়াইবার জন্য এমনই আনন্দের সহিত অগ্রসর হইতেন, যেন বরযাত্রিরূপে কোন বিবাহ সভায় যাইতেছেন। এবং যে পৰ্য্যন্ত তাঁহাদের দলের কয়েক ব্যক্তি শক্রসেনা পৰ্যন্ত পেঁৗছতে না পারিতেন, সে পৰ্যন্ত দলে দলে কামানে ধ্বংস হইতেন। সে কোন উদ্দীপনা ছিল, যাহা তাঁহাদিগকে এমন ভীষণ মৃত্যুমুখে লইয়া যাইত? তাহা কেবল পয়গম্বরের-কোরআনের মহিমা, এবং ইসলামপ্রেম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, (তাহাদের) এই ভক্তি পৃথিবীতে ভবিষ্যতেও অটল রহিবে, বরং বৰ্ত্তমান যুগ অপেক্ষা ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল আলোক বিকীর্ণ করবে। (আমীন!)
ভদ্ৰ মহোদয়গণ! এখন আমি আরবীয় পয়গম্পবরের সত্যনিষ্ঠা সম্পবন্ধে একটি প্রমাণ আপনাদের সম্পমুখে উপস্থিত করিতেছি। তাহা এই যে—পয়গম্বরের “নবুয়তে” সৰ্ব্বপ্রথমে বিশ্বাস করিয়াছিলেন তাঁহার সহধৰ্ম্মিনী—যিনি তাহার গাৰ্হস্থ্য জীবনের সমুদয় রহস্য অবগত ছিলেন, আর তাঁহার অতি অন্তরঙ্গ আত্মীয়া ছিলেন বলিয়া তাহার আশৈশব জীবনের স্বভাব-চরিত্র সমুদয় উত্তমরূপে জ্ঞাত ছিলেন। এই যদি আপনারা বিবেচনা করিয়া দেখেন, তবে, পয়গম্ববরের সত্যপরায়ণতা সম্প্ৰবন্ধে অতি জ্বলন্ত প্ৰমাণ পাইবেন। আপনারা নিজেরাই বেশ জানেন যে, কোন বিজ্ঞ বক্তৃতানিপুণ ব্যক্তি কোন সভা সমিতিতে গিয়া বেশ ঝাড়া দুই ঘণ্টা উৎকৃষ্ট বক্তৃতা প্রভাবে শ্ৰোতৃবৰ্গকে মোহিত ও চমৎকৃত করিয়া স্বমতে তাঁহাদের বিশ্বাস জন্মাইতে পারে- যেহেতু সে সময় লোকে তাহাকে কেবল বক্তৃতা—মঞ্চেই দেখে; তাহার আভ্যন্তরীণ জীবনের অবস্থা কিছু জানে না। কিন্তু ইহা বড় কঠিন, এমন কি অসম্ভব যে নিজের স্ত্রী, কন্যা, জামাতা প্রভৃতি অতি নিকটবতী আত্মীয়গণ তাহার সত্যতার সাক্ষ্যদান করে– যদি সে ব্যক্তি বাস্তবিক তদ্রােপ নিম্পর্মল ও সত্যপর না হয়। আমাদের মতে ইহারই নাম “পয়গম্বর” এবং সত্য বলিতে কি এমন বিশ্বব্যাপী জয়লাভ হজরত মসিহের (যীশুর) ভাগ্যেও ঘটে নাই।(5)
আরবীয় পয়গম্ববরের আত্মীয়বান্ধবদের মধ্যে কেবল তাহার পিতৃব্য আবু তালেবই (?) এমন ছিলেন, যিনি কেবল নিজের একওঁয়ে গোড়ামীর জন্য তাঁহার ধৰ্ম্মমতে (প্ৰকাশ্যে) বিশ্বাস করেন নাই। তিনি সম্প্রান্ত কোরেশ বংশের দলপতি ছিলেন বলিয়া আপন পুরাতন পৈতৃক ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দেওয়া নিজের জন্য মানহানিকর বোধ করিতেন; নতুনবা তাঁহার কায্যকলাপে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইত যে, তিনি পয়গম্বরের ধৰ্ম্মে সম্পূর্ণ বি ছিলেন। কারণ তিনি রাসুলোল্লাহকে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছিলেন, “হে পিতৃব্যপ্ৰাণ! তুমি অসঙ্কোচে আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতে থাক; আমার জীবদ্দশায় কাহার সাধ্য যে, তোমার দিকে কটাক্ষপাত করে?” একদিন আবু তালেব স্বীয় পুত্র হজরত আলীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর ধৰ্ম্ম বিশ্বাস কি? আর তুই মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে কি মনে করিস?” হজরত আলী অত্যন্ত সম্পমান। অথচ উৎসাহের সহিত উত্তর করিলেন, “পিতৃদেব! আমি একমাত্র অদ্বিতীয় আল্লাহকেই পূজনীয় মনে করি, এবং মোহাম্মদকে আল্লাহতালার প্রকৃত প্রেরিত বলিয়া মানি। আব এই জন্য পয়গম্বরের সংশ্ৰব পরিত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইব না।”