বাল্যজীবন অতিক্রম করিয়া তিনি কৈশোরে উপনীত হইলেন। এখন জীবিকা-অৰ্জ্জনের নিমিত্ত তিনি আপন কোন বিধবা আত্মীয়ার গৃহে কৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য হইলেন। উক্ত বিধবা খাদিজা বিবি তাহাকে পণ্যদ্রব্যসহ বাণিজ্য উপলক্ষে শামদেশে প্রেরণ করিতেন। এই বিষয়কর্ম্মে খজিদাবিবি দেখিতে পাইলেন যে তাহার এই নূতন কৰ্ম্মচারী অতিশয় ধৰ্ম্মভীরু, ন্যায়পরায়ণ, মিতব্যয়ী এবং অতি বিশ্বাসী। অতঃপর তিনি ইহার সহিত পরিণীত হন।
ইহা স্মরণ রাখা কৰ্ত্তব্য যে, এই নবীন যুবক যাহার নাম মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওসাল্লাম) ছিল, সে সময়ে পয়গম্বর হন নাই। আর তাঁহার পত্নী হজরত খাদিজাও তাঁহার ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অনুবৰ্ত্তিনী ছিলেন না; তিনি স্বয়ং অল্পবয়স্ক তরুণ এবং তাঁহার জায়া তদপেক্ষা দ্বিগুণ বয়োজেষ্ঠা ছিলেন। কিন্তু বিবাহের পর তাহারা এমন সুখের দাম্পত্য জীবন ভোগ করিয়াছিলেন যে, পৃথিবীতে তেমন মধুর দাম্পত্যজীবনের উচ্চ আদর্শ আর কেহ দেখাইতে পারিয়াছে কি না সন্দেহ–আর তেমনই ভাবে তাঁহাদের বিবাহ জীবনের পূর্ণ ২৬ বৎসর অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর হজরত খাদিজার মৃত্যু হইল। অতঃপর পয়গম্বর সাহেবের স্বভাব চরিত্র ও কাৰ্যকলাপ সৰ্ব্বদাই অতি প্ৰশংসনীয় ছিল। যখন তিনি মক্কার সন্ধীর্ণ গলিকুচাতে যাতায়াত করিতেন, সে সময় তত্ৰত্য ক্ৰীড়ারত অবোধ শিশুগণ তাঁহার পদযুগল জড়াইয়া ধরিত, আর তিনি সততই তাহাদের সহিত স্নেহসিক্ত মিষ্টভাষায় কথা বলিতেন, তাহদের মস্তকে হস্তামর্শন করিতেন। কেহ কখনও শুনে নাই যে, তিনি প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছেন। তিনি সৰ্ব্বদা বিপদগ্ৰস্তের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকিতেন; বিধবা ও পিতৃহীন শিশুদের সান্তুনা ও প্ৰবোধ দান তাহার নিত্য কম্পর্ম ছিল। প্রতিবেশিবৰ্গ তাহাকে “আমীন” (বিশ্বস্ত) বলিয়া ডাকিত। “আমীন” শব্দের অর্থ বিশ্বাসভাজন-এমন উচ্চ ভাবপূর্ণ উপাধি কেবল শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিই বিশ্ব জগতের নিকট প্রাপ্ত হইতে পারেন। এখন আপনারা একটু চিন্তা করিয়া দেখুন ত; যে ব্যক্তির বাহ্যিক জীবন জগতেব পক্ষে এমন উপকারী এবং সুখ শান্তিপ্রদ ছিল, তাহার আভ্যন্তরীণ জীবন কেমন হইতে পারে। অহো! (সত্য তত্ত্বজ্ঞান লাভের নিমিত্ত) তাহার আন্তরিক ব্যাকুলতার বন্যাস্রোতেব তাড়না তাঁহাকে বনে বনে ও জনপ্রাণিগৃন্য মরুভূমি ভাসাইয়া লইয়া যাইত। তিনি কতৰ্ধার দিবানিশি অনশনে অনিদ্রায় বিপৎসস্কুল পৰ্ব্বতকন্দিরে বাস করিতেন। তিনি যে ভাবে আত্ম-বিস্মৃত হইয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ঈশ্বর-অনুসন্ধান করিতেন, তাহা বৰ্ণনা করিবার উপযুক্ত ভাষা দুর্লভ; অথবা ইহার মৰ্ম্ম কেবল তাহারাই বুঝিতে পারেন, র্যাহারা একাগ্রচিত্তে খোদার পথে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছেন।
ক্রমে হজরত মোহাম্মদের (দঃ) এই প্রকার ধ্যান-আরাধনা এত বৃদ্ধি পাইল যে, তিনি লোকালয় পরিত্যাগ পূর্বক দূরে-অতি দূরে-ঘোর অরণ্যে চলিয়া যাইতেন; দুৰ্গম ও ভয়ঙ্কর গিরিগুহায় মাসাধিককাল পৰ্যন্ত বাস করিতেন—সেখানে শুধু সিজদায় (নতশিরে) পড়িয়া অনবরত রোদন ও বিলাপ ব্যতীত তাঁহাব অন্য কোন কাজ ছিল না। এমনকি তিনি অনু্যন পঞ্চদশ বর্ষ এই ভাবে যাপন করিলেন-অবশেষে সেই শুভ মুহূৰ্ত্ত আসিল, যখন দৈববাণী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “উঠ! খোদায় পাকের (পবিত্র ঈশ্বরের) নাম উচ্চারণ কর!” কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিলেন না, সে শব্দ কাহার; অথবা ঐ আকাশবাণী বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য দৈববাণী কি না? কারণ তিনি বেশ জানিতেন যে, তিনি নিরক্ষর লোক ছিলেন। তাঁহার সন্দেহ হইত যে, ইহা হয়ত তাঁহার ভ্রম বা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র-কিম্বা তাঁহার অহংজ্ঞান তাহাকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত ঐ রূপ শব্দ করিতেছে; এবং সম্ভবতঃ ইহা সেই দৈববাণী নহে, যাহা স্বয়ং খোদাতালার নিকট হইতে পয়গম্বরগণ শুনিতে পাইতেন, যাহাকে “এলহাম” কিন্বা “অহি” বলে।
অবশেষে আর একরার যখন তিনি ঈশ্বর-চিন্তায় অত্যন্ত আকুল ছিলেন, সহসা তাঁহার চতুস্পার্শ্ব এক অলৌকিক স্বগীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, আর সেই আলোকরশির মধ্যে একটী জ্যোতিষ্মান মূৰ্ত্তি দেখা দিয়া বলিলেন, “যাও, সত্য নাম উচ্চারণ কর।” একরার সাহসে ভর করিয়া সভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি কাহাকে ডাকিব?” ইহার উত্তরে স্বৰ্গদূত তাঁহাকে ঈশ্বরের একত্ত্ব, ফেরেশতাদের রহস্য, পৃথিবীর সৃষ্টি এবং মানবজাতির অস্তিত্ব বিষয়ে শিক্ষাদান করিলেন এবং তাঁহাকে সেই দায়িত্বপূর্ণ গুরুতর কৰ্ম্মভারের (পয়গম্বরীর) কথাও বলিলেন, যে জন্য তাঁহার জন্ম হইয়াছে। অর্থাৎ দেবদূত বলিয়া দিলেন যে, তাহাকে বিশ্ব জগতের ধর্ম্মপথ প্ৰদৰ্শক এবং উপদেষ্টার কার্য্যভার সমর্পণ করা হইয়াছে।
এদিকে দেবদূত অদৃশ্য হইলেন, ওদিকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি এখন হইতে আরব দেশের পয়গম্বর নামে অভিহিত হইবেন, অত্যন্ত অস্থির ও ভীতি বিহবল চিত্তে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন এবং অদ্ধ অচৈতন্য অবস্থায় ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িলেন। পতিপ্ৰাণা সতী হজরত খাদিজা উপযুক্ত শুশ্রুষা সহকারে তাঁহার তাদৃশ বিহবলতার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে পয়গম্বর সাহেব আনুপূর্বিক সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করিয়া বলিলেন, “বোধ হয় ইহা, আমার মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ।” ইহাতে পতিপরায়ণ সাধবী রমণী অতিশয় সান্তনাপূৰ্ণ মধুর বচনে তাহার নিস্তেজ হৃদয়ে বল সঞ্চার করিয়া বলিলেন, “না, না, তুমি সত্যবাদী- বিশ্বাসী—“আমীন”; প্রতিজ্ঞা পালনে যত্নবান; পিতৃহীনের প্রতি স্নেহ বৰ্ষণ কর; দরিদ্র, আতুর ও বিধবার প্রতি দয়া করিয়া থাক—এমন লোককে বিশ্বপাত কখনই অকালে নষ্ট করবেন না। প্ৰভু খোদাতালা কখনও বিশ্বাসী ভক্তদিগকে প্রবঞ্চনা করেন না। উঠ, এখন সেই দৈববাণী—প্রকৃত সত্য দৈববাণীর প্রত্যাদেশ অনুসারে কাৰ্য্য কর।”