গও। তিনি বিদ্রাপ করিয়া আমাদের সৌরজগৎ বলেন। কিন্তু আইস আমরা ঐ বিদ্রািপ হইতে একটা ভাল অর্থ বাহির করিয়া লই।
কও। জান না? আঁস্তাকুড়ের আবর্জনার ভিতরও অনেক সময় মূল্যবান বস্তু লুক্কায়িত, থাকে!
গও। হ্যা, অদ্য আমরা ঐ বিদ্রুপ-আবর্জনা হইতে একটা মূল্যবান জিনিষ বাহির করিতে চেষ্টা করি। কওসর! তুমি চেষ্টা করিবে, মা?
কও। আপনিই চেষ্টা করুন।
গওহর আরম্ভ করিলেন, “বলিয়াছি ত প্রত্যেক গ্রহই নিয়মমত সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। সূৰ্য্যকে প্ৰদক্ষিণ করা যেমন গ্ৰহগণের কৰ্ত্তব্য, তদ্রুপ তাহাদিগকে আলোক প্রদান ও তাহাদের প্রত্যেকটিকে যথাবিধি আকর্ষণ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেরুদণ্ডের উপর ঘোরা সূৰ্য্যের কৰ্ত্তব্য। এই সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকে আপনি আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতেছে। কাহারও কৰ্ত্তব্য সাধনে ত্রুটি হইলে সমষ্টির বিশৃঙ্খলা ঘটে।
“মনে কর প্রত্যেক লোকের গৃহই একটি সৌরজগৎ এবং গৃহস্থের আত্মীয় স্বজনেরা ঐ সৌরপরিবারের এক একটি গ্রহ। গ্রহদের কৰ্ত্তব্য গৃহস্থের অবস্থানুসারে তাহারই মনোনীত পথে চলা। এবং গৃহস্থেরও কৰ্ত্তব্য পরিবারস্থ লোকদিগকে স্নেহরশ্মিদ্বারা আকর্ষণ করা, তাহাদের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতি দৃষ্টি রাখা—এমনকি (দারিদ্র্যবশতঃ) খাদ্যের অপ্রতুলতা হইলে, প্রথমে শিশুদের, অতঃপর আশ্ৰিত পোষ্যবৰ্গকে আহার করাইয়া সৰ্ব্বশেষে তাহার ভোজন করা উচিত। যদি এই পরিবারের একটি লোকও স্বীয় কৰ্ত্তব্যপালনে অবহেলা করে, তবে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়া পরিবারটি নানা প্রকার অশান্তি ভোগ করবে।
“যেমন কোন গ্রহ যদি আপন কক্ষকে অতিক্রম করিয়া দূরে যায়। তবে সূৰ্য্যের আকর্ষণ বিমুক্ত হইলে, সে অন্য কোন গ্রহের সহিত টক্কর খাইয়া নিজে চূর্ণ হইবে এবং অপর গ্রহকেও বিদপগ্ৰস্ত করিবে। সুতরাং যাহার যে কক্ষ, তাহাকে সেই কক্ষে থাকিয়া স্বীয় কৰ্ত্তব্যবৰ্ত্তে চলিতে হইবে।”
ঠিক এই সময় জাফর আসিয়া বলিলেন, “সালাম ভাই! পথে আসিয়াছ। আমিও ত তাহাই বলি, যাহার জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট আছে, সে তাহা অতিক্রম করিলে বিশজখলা ঘটিবে। সমাজরূপ সৌরজগৎ স্ত্রীরূপ গ্রহদের জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট করিয়াছে সে সীমা উল্লঙ্ঘন করা স্ত্রীলোকদের উচিত নহে।”
গও। মাফ কর ভাই! আমাকে আগে আমার বক্তব্য বলিতে দাও! তুমি আসন গ্ৰহণ কর।
আখতার। (জনাস্তিকে কওসরকে) মাম্ম কথা বলিবার ভঙ্গীও জানেন না! “সমাজরূপ সৌরজগৎ” আর “স্ত্রীরূপ গ্ৰহ” বলা হইল!
কও। তাই ত! সমাজটু নিজে সৌরজগৎ হইলে গ্রহদের সীমা নির্দিষ্ট করিবার অধিকার কি? ঈশ্বর স্বয়ং সকলের সীমা নির্দেশ করিয়াছেন। আচ্ছা এখন উহাদের কথা শুনি।
জাফর আসন গ্রহণ করিলে পর বালিকারাও আসন গ্ৰহণ করিল। জাফরকে দেখিয়া ইহারা সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিয়াছিল।
গওহর বলিয়া যাইতে লাগিলেন, “কেবল অবলারা সীমা অতিক্ৰম করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে। ইহাই নহে, পুরুষেরাও স্বীয় কক্ষ লঙ্ঘন করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে।”
জাফ। পুরুষদের গন্তব্যপথ ত সীমাবদ্ধ নহে-তাহাদের আর কক্ষচ্যুত হওয়া কি?
গও। পুরুষেরাও স্বেচ্ছাচারী হইতে পারে না। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে। তুমি কি স্ত্রীপুত্রকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া কোথাও যাইতে পার?
জাফ। না।
গও। তবে কিরূপে বল, তোমার পথ সীমাবদ্ধ নহে?
জাফ। তবু আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে।
গও। কৰ্ত্তব্যে অবহেলা করিবার ক্ষমতা নাই।
মুশ। আব্বা! আমরা ত সকলেই নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য কাৰ্য্য করি, কিন্তু নয়ীমু ও মাসুমা ত কিছু করে না?
রাবু। তাহারা এত ছোট যে তাহাদের কৰ্ত্তব্য কিছুই নাই।
গও। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে বই কি? নয়ীমুর কৰ্ত্তব্য যথানিয়মে আহার নিদ্রা পালন করা ও খেলা করা। মাসুমার কৰ্ত্তব্য খাওয়া, নিদ্রা যাওয়া, হাসা এবং দৌড়াইতে শিখা।
রাবু। ঈশ! ভারী ত কৰ্ত্তব্য! উহারা ও কাজ না করিলে আমাদের এখানে এমন কি বিশৃঙ্খলা ঘটিবে?
কও। উহারা এখনও তোমাদের মত দুষ্টমী শিখে নাই; তাই উহারা যথানিয়মে স্ব স্ব কৰ্ত্তব্যপালন করে। যদি মাসুমা না হাসে বা নয়ীমা না খায়। তবে বুঝিতে হইবে তাহাদের অসুখ হইয়াছে। তখন তাহাদের শুশ্রুষার জন্য আমাদিগকে ব্যস্ত থাকিতে হইবে।
গও। তাহাদের চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত থাকিলে আমাদের দৈনিক কাৰ্য্যে বিশৃঙ্খলা ঘটিবে কি না?
রাবু। ই-বুঝিলাম!
গও। আর এক কথা মনোযোগের সহিত শুন। আমি বলিয়াছি, গ্ৰহমোলা স্ব স্ব কক্ষে থাকিয়া সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই প্ৰদক্ষিণ কাৰ্য্যে গ্রহদের সাদৃশ্য ও একতা আছে—অর্থাৎ সকলেই ঘুরে, এই হইল সাদৃশ্য। কিন্তু তাই বলিয়া যে সকল গ্রহই একই সঙ্গে উঠে, একই সঙ্গে বসে তাহা নহে! (জাফরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) তাহাদের আবার ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। জাফর ভাই যে বলেন, সৌরপরিবারের অবলারােপ গ্ৰহদের ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নাই, ইহা তাঁহার ভ্রম।
জাফ। ভ্ৰম নহে-ঠিক কথা। অবলাকে কোন প্রকার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নহে। তুমি হয়ত মাদ্রাজের Christian Tract Societyর প্রকাশিত Indian Reform সম্বন্ধীয় পুস্তিকাসমূহ হইতে এ স্বাধীনতার ভাব গ্রহণ করিয়াছ! খৃষ্টধৰ্ম্ম প্রচারকগণ যাহা বলেন, তোমার নিকট তাহা অভ্রান্ত সত্যরূপেই পরিগণিত হইয়াছে।
গও। আমি আজি পৰ্য্যন্ত উক্ত পুস্তিকার একখানিও পাঠ করি নাই। খৃষ্টানদের নিকট কিছু শিখিতে যাইব কেন? ঈশ্বর কি আমাকে বুদ্ধি দেন নাই? আর আমি ত এই কারসিয়ঙ্গ, শৈলে আছি, এই সময় তুমি আমার বাড়ী অনুসন্ধান কর গিয়া, যদি আমার বাড়ীতে “Christian Tract Societyর প্রকাশিত পুস্তিকা” একখানিও দেখিতে পাও, তবে আমি তোমাকে হাজার (১০০০) টাকা দিব!