এস্থলে পাৰ্ব্বত্য শর্টকাট পথের একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। প্রস্তুর সন্ধুল গড়ানিয়া খাড়া সংক্ষিপ্ত পথকে short cut বলে। শর্টকাট পথ বড়ই দুৰ্গম; কোথাও উচ্চ প্রস্তর, কোথাও গৰ্ত্ত, কোথাও এমন ঢালু যে পা রাখা যায় না। পাথর কাটিয়া ভাঙ্গিয়া অশ্বাদি, গাড়ী ও (“নীচেকা”) মানুষের জন্য গবৰ্ণমেন্ট যে অপেক্ষাকৃত সমতল, কিন্তু ক্ৰমোচ্চ সুগম পথ নিম্পর্মাণ করিয়াছেন; তাহাকে স্থানীয় ভাষায় “সরকারী সিটক” বলে। ঐ সরকারী সর্টকগুলি অনেক দূর আঁকিয়াবাকিয়া যায়। সচরাচর গুর্থ ও ভুটিয়াগণ সরকারী ঘুরাও পথে না চলিয়া শর্টকাটে যাতায়াত করে। কারণ যেখানে শর্টকাটে পাঁচ মিনিটে যাওয়া যায়, সেইখানে সরকারী সটীক দিয়া গেলে প্রায় ২০/২৫ মিনিট লাগে এবং সাতবার ঘুরিতে হয়।
নূরজাহাঁ পুনরায় বলিলেন, “এই অশিক্ষিত পাহাড়ীদের শিভালরী। অবশ্য অবশ্য প্ৰশংসনীয়।”
গও। উহাদের নিকট আমাদের ভদ্রতা শিক্ষা করা উচিত। আমরা বৃথা ভদ্রতা ও সভ্যতার বড়াই করি।
নূর। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করিয়াছ, ভাই? পাহাড়ী বা ভুটিয়া স্ত্রী পুরুষ-কেহই ভিক্ষা করে না।
জাফ। তাহদের ভিক্ষার প্রয়োজন হয় না বলিয়া।
গাঁও। প্রয়োজন না হওয়াও ত প্ৰশংসনীয়।
এইরূপ কথাবাৰ্ত্তায় তাহারা পথ-ক্লান্তি ভুলিতেছিলেন। কারসিয়ঙ্গ ক্টেশনের নিকটে আসিয়া কওসর বলিল,-“কি রাবু! বড় ক্লান্ত না কি?”
রাবু। না, মোটেই না।
জাফ। আরও এক মাইল যাইতে হইবে, জনিস?
ক্রমে তাহারা একটা বেঞ্চের নিকট আসিলেন। তথায় কয়েকজন গুখা বসিয়াছিল, তাহারা ইহঁদিগকে দেখিয়া সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিল। নূরজাহাঁ বলিলেন, “একটু বসা যাউক”।
জাফ। না, চল আর বেশী দূর নাই।
বাদু। হাঁ মাস্মা! বসুন না! ঐ দেখুন আকাশে আগুন! স্বাক্ষর পশ্চিমে চাহিয়া দেখিলন, সতাই আকাশে আগুন লাগিয়াছে। সবই যেন অগ্নিময়।
আখ। দেখ আপা! কাঞ্চনজঙ্ঘায়ও আগুন লাগিয়াছে!
জাফ। বাস্তবিক বড় চমৎকার দৃশ্য তা! এখান হইতেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দুইতিনটি শৃঙ্গ দেখা যায়! অস্তমানরবির সোণালী কিরণে সত্যই সে কাঞ্চনকান্তি লাভ করিয়াছে। বোধ হয় যেন দিনমণি পশ্চিম গগনে আত্মগোপন করিতে যাইতেছে—আর সুকুমার মেঘগুলি তাহার পশ্চাতে ছুটয়াছে। প্রদোষে এমন শোভা হয়, পূৰ্ব্বে লক্ষ্য করি নাই। ওদিকে অলকমালা রাঙ্গাকিরণে স্নান করিয়া স্বর্ণবৰ্ণ লাভ করিতেছে! মৃদুমন্দ সমীরণ যেন তাহাদের সহিত লুকাচুরি খেলিবার ছলে মেঘমালাকে ইতস্ততঃ বিক্ষপ্ত করিতেছে!
গও। সালাম ভাই! তুমিই ত বল কবিত্ব মস্তিষ্কের রোগ রোগ বিশেষ!
জাফ। যে এখানকার জলবায়ুতে ঐ রোগটা আছে। পূর্ববঙ্গের জলবায়ুতে ম্যালেরিয়া, হিমালয়ের জলবায়ুতে কবিত্ব।
গও। কেবল কবিত্ব নহে, বৈরাগ্য-যোগশিক্ষা ইত্যাদিও! এইখানে বসিয়া স্রষ্টার লীলাখেলা দেখ–তোমার সান্ধ্য-উপাসনার ফল প্রাপ্ত হইবে! এখানে নিজের ক্ষুদ্রত্ব বেশ স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করা যায়।
নূর। বলিতে কি, অভ্যাসমত উপাসনায় এমন ভাবের আবেগ, ভক্তির উচ্ছাস থাকে না। গও। আর আমরা যে সামাজিক নিয়মের বশবৰ্ত্তী হইয়া স্ত্রীলোকদের এমন উপাসনাঅর্থাৎ স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্ৰ্য দর্শন স্বইতে বঞ্চিত রাখি, ইহার জন্য ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর দিব? যে চক্ষুর কাৰ্য্য দর্শন করা, তাহাকে চিরঅন্ধ করিয়া রাখি-ধিক আমাদের সভ্যতায়! ইনি না কি এখানে আসিবার পূৰ্ব্বে কখনও উষার প্রথম আলোক ও সূৰ্য্যোদয় দেখেন নাই।
জাফ। সম্ভবতঃ আমিও দেখি নাই-সেজন্য আমি ত একরারও বিলাপ করি না! গও। কিন্তু তুমি মাঠে বাহির হইলেই দেখিতে পাইতে; তোমার গতি ত অবারিত। আর মনে রাখিও, যথাসাধ্য জ্ঞানেন্মেষ ধর্ম্মেরই এক অঙ্গ।
জাফ। জ্ঞান বৃদ্ধি হইলে লোক নাস্তিক হয়, এইজন্য কুলললনাবৃন্দকে জ্ঞান হইতে দূরে রাখা আবশ্যক।
গও। যত অভিশাপ কুলবালার উপর! ইহা তোমার বিষম ভ্ৰম; জ্ঞানের সহিত ধৰ্ম্মের বিরোধ নাই। বরং জ্ঞান ধর্ম্মের এক প্রধান অঙ্গ।
আরও অনেক কথা হইল। এদিকে বালিকার দলও নীরব ছিল না। আখতার মৃদুস্বরে বলিল, “দেখ আপা! ওদিকে দূরে উচ্চ গিরিচূড়ে চায়ের শ্যামল ক্ষেত্রগুলি সান্ধ্য রবিকিরণের তরল স্বর্ণবর্ণে স্নান করিয়া কেমন সুন্দর দেখাইতেছে! আবার কেমন ধীরে ধীরে ঈষৎ ধূমল বর্ণের বাষ্পরূপী ওড়নায় নিজ নিজ স্বর্ণকায় আবৃত করিতেছে!”
কও। ঠিক বলিয়াছ, বোন। আমিও তাঁহাই ভাবিতেছিলাম। সৃষ্টিকৰ্ত্তার কি অপোর মহিমা! তাঁহার শিল্পনৈপুণ্যের বলিহারি যাই!
বাদু। চল এখন বাসায় যাই! আখ। যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা কেন, দিদি?
বদু। আর এখানে থাকিয়া কি দেখি্বে? ঐ দেখা ক্ৰমে সন্ধ্যা সমাগমে বুঝি শীত বোধ হওয়ায় চা-বাগানগুলি অন্ধকার লেপে শরীর ঢাকিতেছে! আর ত কিছুই দেখা যায় না!
কও। চা-বাগানের শীত বোধ হউক না হউক, বন্দুর শীতবোধ হইতেছে! কারণ বদু ভ্ৰমক্রমে শাল আনে নাই।
সকলে বাসা অভিমুখে চলিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর গওহর আলী দুহিতাদিগের পাঠগৃহে বসিয়া তাহাদিগকে পড়াইতেছেন। পাঠ শেষ * হইলে তিনি অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল তাহদের সহিত গল্প করেন। গঙ্গাপচ্ছলে তিনি তাহাদিগকে কখন ঐতিহাসিক কখন ভৌগোলিক বিষয়ে শিক্ষা দিয়া থাকেন। অদ্য তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় সৌরজগৎ।
মুশতরী। ভাল কথা, আব্বা! মাম্মা কেন আমাদিগকে সীের-চক্ৰ বলেন? আমরাও কি আকাশে ঘুরি?