জাফ। শুন, আর একটি কাজের কথা বলি; আগামী বৎসর ত কাওসরুর বিবাহ, এখন তাহাকে লইয়া তোমরা পাহাড় পৰ্ব্বতে বেড়াও, বরপক্ষীয় লোকেরা শুনিলে কি বলিবে?
নূর। বরপক্ষের ইহাতে আপত্তি নাই, জানি।
গও। বর ত শিমলাতেই কাজ করেন। আর স্বামীর সহিত স্ত্রী বেড়াইবে, পিতার সহিত কন্যা বেড়াইবে, তাহাতে অন্য লোকের আপত্তি করিবার অধিকার?
জাফ। বেশ, মঙ্গলময় তোমাদের মঙ্গল করুন। বরটিও তোমাদের মনোমত পাইয়োছ। তাহা হইলে দেখিতেছি আমার নির্বাচিত পাত্রের সহিত আখতরের বিবাহ দিবে না।
গাও। না। কওসরের ভাবী দেবরের সহিত আখতরের বিবাহ হইবে।
জাফ। তবে উভয় কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে দাও না কেন?
গও। তাহা হইলে ভালই হইত। কিন্তু সে ছেলেটি এখন বিলাতে।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
হিমালয়ের ক্রোড়স্থিত টুঙ্গ নামক স্থানে একটি ঝরণার ধারে কয়েক ব্যক্তি বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যে যে সৰ্ব্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠা, সে বলিল,-“মেজ আপা! দেখি ত এই ঝরণা কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে আবার কোথায় চলিয়াছে! তুমি বলিতে পার শেষে কোথায় গিয়াছে?”
আখতার। না, রাবু! আমি তা জানি না শেষে কোথায় গিয়াছে। আসিয়াছে ঐ পাহাড়ের পাষাণ বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া।
রাবু। সামান্য জলধারা পাষাণ বিদীর্ণ করিল কিরূপে? তাহা কি সম্ভব?
কওসর। ঐ জলধারা কেবল পাষাণ বিদীর্ণ করিয়াছে, তাহাঁই নহে; কত প্ৰকাণ্ড প্রস্তর খণ্ড উহার চরণতলে গড়াইতে গড়াইতে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া বালুককণায় পরিণত হইয়াছে।
প্রকাণ্ড প্রস্তর বালুকায় পরিণত হওয়ার কথাটা রাবু সহজে ধারণা করিতে না পারিয়া পিতাকে জিজ্ঞসা করিল, সত্য আব্বা?
গওহর কথা কহিবার পূৰ্ব্বে জাফর বলিলেন, “হাঁ সত্য। তোরা য়েমন পিতৃক্ৰোড়ে নির্ভয়ে ক্রীড়া করিত, ঐ নির্ঝরগুলি সেইরূপ পাষাণময় পিতৃবক্ষে নৃত্য করিতেছে—পিতা তবু অটল! হিমাদ্রিও ঠিক গওহরেরই মত সহিষ্ণু! আর শোন, ষ্টিমার হইতে যে বিশালকায়া জাহ্নবী দেখিয়াছিস, এইরূপ কোন একটা শিশু নিবন্ধুরই তোহর উৎস।”
রাবু। (আনন্দ ও উৎসাহের সহিত) তবে মাম্মা! বলুন ত ইহার কোনটা গঙ্গার উৎস?
জাফ। গঙ্গার উৎস এখানে নাই।
কও। কি ভাবিতেছ আখতার?
আখ। ভাবিতেছি,-এই ক্ষীণাঙ্গী ঝরণাগুলি হিমালয়ের হৃদয়ে কেমন গভীর হইতে গভীরতম প্ৰণালী কাটিয়া কলকলস্বরে স্রষ্টার স্তবগান গাহিতে গাহিতে চলিয়াছে! বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-আলস্য ঔদাস্য নাই–অনন্ত অবারিত গতিতে চলিয়াছে!
রাবু। মেজ আপা! আমিও একটি নদীর উৎস আবিষ্কার করিলাম!
আখ। বটে?
কও। কি আবিষ্ককার করিয়াছিস বল ত?
রাবু। কারসিয়ঙ্গের পাগলা ঝোরাই পাগলা নদীর উৎস।
আখ। দূর পাগলি!
বদর। রাবু কিন্তু কথাটা একেবারে অসঙ্গত বলে নাই,-ক্রিস্রোতা নদী ত এই দাৰ্জিলিঙ্গের আশপাশেই–
কও। ধন্য তোমাদের গবেষণায়। বদু ত বেশ পণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে!
বদু। যদি গবেষণায় ভুল হইয়া থাকে, তবে ওকথা থাক; আর এক মজার কথা বলি,— বেশ খেয়াল করিয়া দেখ ত, পাহাড়ের বুকের ভিতর দিয়া রেলপথ কেমন আঁকিয়াৰ্যাকিয়া গিয়াছে—একদিকে সুউচ্চ পৰ্ব্বত, অন্যদিকে নিমস্থিত অনুচ্চ পাহাড়ের স্তুপ-একটির পর অপরটি ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মত দেখায়! ইহাকে পৰ্ব্বত-তরঙ্গ বলিলে কেমন হয়?
কও। বেশ ভাল হয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা তোমার মনে আছে বোন?
বাদু। না দিদি! মনে ত পড়ে না।
রাবু। মাম্মা! আমি ঐ ঝরণার জল স্পর্শ করি গিয়া?
জাফ। যাবি কিরূপে? অবতরণের পথ যে দুৰ্গম।
রাবু। আপনি অনুমতি দিন,-আমি যেমন করিয়া পারি, যাইব। সেজ। আপা! তুমিও
বাদু। না, তুমি একাই যাও।
জাফর অনুমতি দিলেন। রাবু অতি কষ্টে অগ্রসর হইল; শেষে এক প্রকাণ্ড প্রস্তর তাহার গতিরোধ করিল। সেটি অতিক্রম না করিলে জলস্পর্শ করা হইবে না। উপর হইতে কওসর শাসাইল, “দেখিস কাপড় ভিজে না যেন।” প্রায় হামাগুড়ি দিয়া অতি সাবধানে রাবু সে প্রস্তর অতিক্রম করিল! শীতল জল অঞ্জলি ভরিয়া লইয়া খেলা করিতে লাগিল।
তদর্শনে বন্দুর একটু হিংসা হইল। সে রেলিং-এর ধারে দাড়াইয়া বলিল,-“কিলো রাবু! স্বর্গে পঁহুছিয়াছিস যে? তোর আনন্দের সীমা নাই! তুই তবে থাক ঐখানে,-আমরা bळ्ळि!”
নূরজাহীও ডাকিলেন, “আয় মা! বেলা যায়।” সকলে আরও কতকাদূর অগ্রসর হইলেন। ইহারা টুক্ত হইতে পদব্ৰজে কারসিয়ঙ্গ চলিয়াছেন।
পথে দুই তিনজন পাহাড়ী তাহাদিগকে দেখিয়া পথ ছাড়িয়া দিয়া একদিকে দাড়াইল। গওহর জাফরকে বলিলেন, “দেখিলে ভাই ইহাদের শিভালরী (অবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন)?”
জাফ। ইহা উহাদের অভ্যাস, অনেকে সময় স্ত্রীলোকেরাও আমাকে সুপথ ছাড়িয়া দিয়া পথিপার্শ্বে দাড়ায়।
নূর। যেহেতু তাহারা “নীচেকা আদমি”কে দুর্বল মনে করে। জাফ। আমি কিন্তু স্ত্রীলোকের নিকট দুর্বলতা স্বীকার করি না। গও। যে সবল তাহার নিকট দুর্বলতা স্বীকার করায় দোষ কি? জাফ। যাহাই হউক, স্ত্রীলোককে আমি কায়িক বলের শ্ৰেষ্ঠতা দিব না!
গও। কেন দিবে না? “Give the devil even his due” (শয়তানকেও তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দান কর)।
জাফ। কিন্তু আমি রমণীকে তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দিতে অক্ষম!
গও। তবে একরার শর্টকাট পথে কোন পাহাড়িনীর সহিত race (বাজী) দৌড়িতে চেষ্টা করা দেখি!
জাফ। শর্টকাটো? তাহা মানুষের অগম্য! নূর। তবে ঐ দুৰ্গম পথে যাহারা পৃষ্ঠে দুই মণ বোঝা সহ অবলীলাক্রমে আরোহণ ও অবরোহণ করে, তাহাদের নিকট দুর্বল বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা কেন?