গও। ভাই! তুমি দিনকতক এখানে থাক, তাহা হইলে তুমিও কবি হইতে পারিবে! কুবিত্ব-জ্ঞান-রহিত অবলার মরুতুল্য হৃদয়েও যখন কবিত্ব-কুসুম ফুটিয়াছে
জাফ। আমি নুরুর অপেক্ষা কম Prosaic (অকবি) নাহি!! আমরা উভয় ভ্রাতা vefisserfjq Prosaic!
গও! কিন্তু এখানকার জলবায়ুএমন যে—
“বারেক দর্শন পেলে চিরমূক কথা কয়!
… মহামুর্থ কবি হয়!”
জাফ। কিন্তু তাহাতে লাভ কি? কবিত্বটা মস্তিক্ষেকের রোগবিশেষ! আমাদের কুলকামিনীরা পাহাড়ে ময়দানে বেড়াইয়া কবি হয়, ইহা কখনই বাঞ্ছনীয় নহে!
গও। তবে কি বাঞ্ছনীয়?
জাফ। বাঞ্ছনীয় এই—তাহারা সুচারুরূপে গৃহস্থলী করে, রাধে, বাড়ে, খাওয়ায়, খায়, নিয়মিতরূপে রোজা-নমাজ প্ৰতিপালন করে।
গও। নিমজ কাহার উদ্দেশ্যে?
জাফ। (আরক্তলোচনে) কাহার উদ্দেশ্যে?–খোদাতালার উদ্দেশে!
গও। বেশ ভাই ঠিক বলিয়াছ। তুমি অবশ্যই জান, একটা পারস্য বয়েৎ আছে-“চিত্র দেখিয়া চিত্রকরকে স্মরণ কর।“ আর ইনি এখনই মহাশিলপী বলিয়া কাহার প্রশংসা করিলেন?
জাফ। মহাশিল্পী ত ঈশ্বরকে বলা হইয়াছে।
গও। তবে কবিত্ব ধর্ম্মের বিরোধী হইল কিসে? ঈশ্বরের সৃষ্টি যতই অধিক দেখা যায়, ততই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির বৃদ্ধি হয়। চক্ষু কৰ্ণ, যথাবিধি খাটাইয়া সৃষ্টি-জগতের পরিচয় না। লাইলে স্রষ্টাকে ভালমতে চিনিবে কিরূপে? পৰ্ব্বতচূড়ায় দাড়াইলে আপনা হইতেই হৃদয়ে ভক্তি-প্রস্রবণ উচ্ছসিত হয়,-তখন অজ্ঞাতে হৃদয়-তন্ত্রে বাজিয়া উঠে
“সেই অদ্বিতীয় কবি আঁকিয়া এমন ছবি
আপনি অদৃশ্য হয়ে আছেন কোথায়?”
জাফ। আমি ভালমতে বাঙ্গালা বুঝি না।
গও। তবে বল—“জর্মীচমন গুল-”(৮)
জাফ। (বাধা দিয়া) রাখ এখন তোমার কবিতা! কন্যাগুলি নিশ্চয় স্কুলে যাইবে?
গও। নিশ্চয়! কওসর, আখতার ও বন্দুর স্কুলে পড়বার সময় গত হইয়াছে, সেজন্য বড় আক্ষেপ হয়।
জাফ। তবে নূরজাহীকেও ভৰ্ত্তি কর! গও। আমার আপত্তি নাই! ইনি ত বলেন যে “শিং কটাইয়া বাছুর দলে মিশিতে ইচ্ছা হয়”।
জাফ। (সহোদরার প্রতি) মিশিলেই পার! তোমারও একান্ত ইচ্ছা নাকি শ্ৰীমতীদের খ্ৰীষ্টান করা??
নূর। মেয়েরা খ্ৰীষ্টান হইবে কেন? আমি অহঙ্কারের সহিত বলি,-আমার মেয়েরা ধৰ্ম্মভ্ৰষ্ট হইতে পারে না ইহারা খাটি সোনা-অনলে সলিলে ধ্বংস হইবে না।
গও। আমিও সাহঙ্কারে বলি, তোমার স্ত্রীর বিশ্বাস (ইমান) টলিতে পারে, কিন্তু আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অটল!
জাফ। আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অস্থায়ী হইল কিসে?
গও। যেহেতু তিনি আপনি ধর্ম্মের কোন তত্ত্বই অবগত নহেন। কেবল টিয়া পাখীর মত নমাজ পড়েন, কোন শব্দের অর্থ বুঝেন না। তাহাকে যদি তুমি স্বর্ণপিঞ্জরে আবদ্ধ না রাখ তবে একরার কোন মিশনারী মেমের সহিত দেখা হইলেই তিনি মনে করিবেন, “বাঃ! যিশুর কি মহিমা!” সুতরাং সাবধান! যদি পোর ত লৌহসিন্দুকে বন্ধ রাখিও।
জাফ। আর নুরু বুঝি নমাজে ব্যবহৃত শব্দসমূহের অর্থ জানে?
গও। জানেন কিনা পরীক্ষা কর! তুমি কি মনে কর এই কুড়ি বৎসরের বিবাহিত জীবনেও আমি আমার অর্দ্ধাঙ্গীকে আমার ছায়াতুল্যা সহচরী করিয়া তুলিতে পারি নাই?
জাফ। তবে দেখ নুরু যে স্কুলে পড়ে নাই সে জন্য কি আটকোহয়াছে? তবে মেয়েগুলার মাথা খাও কেন?
গও। আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেলপথে ভ্ৰমণ করেন নাই, টেলিগ্রাফে সংবাদ পাঠান নাই, সেজন্য তাঁহাদের কিছু আটকাইয়াছিল কি? তবে আমরা টেলিগ্রাম পাঠাই কেন, রেলগাড়ীতে উঠি কেন?
জাফ। আমাদের তা ওসব আবশ্যক হয়।
গও। যাহা আমাদের জন্য আবশ্যক, তাহা আমাদের মহিলাদের জন্যও প্রয়োজন। তাহারা আমাদের আবশ্যক-অনুযায়ী বস্তুই ত যোগাইয়া থাকেন। গ্রাম্য চাষার স্ত্রীরা জরির কাজ জানে না, আচার মোরব্বা প্ৰস্তুত করিতে জানে না। কারণ চাষীদের তাহা আবশ্যক হয় না। ইউরোপীয়া কামিনীরা পান সাজিতে জানে না, কারণ ইউরোপীয় পুরুষদের তাহা আবশ্যক হয় না। আবার আমাদের কুলবালারা চাষা স্ত্রীদের মত ধান ঝাড়িতে জানেন না, যেহেতু আমাদের তা প্রয়োজন হয় না। ক্রমে আমরা কারি, কাটলেট, পুডিং খাইতে শিখিতেছি আমাদের গৃহিণীরাও তাহা রাধিতে শিখিতেছেন। আমাদের ছাড়া তাঁহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কই? এবং তাঁহাদের ছাড়া আমাদেরও নিরপেক্ষ অস্তিত্ব কই? স্কুল কলেজের শিক্ষা যেমন আমাদের আবশ্যক, তদ্রুপ তাঁহাদেরও প্রয়োজন। তোমার পারিবারিক জীবন অপেক্ষা আমার গাৰ্হস্থ্য জীবন অধিক সুখের, ইহা তুমি অবশ্যই স্বীকার করিবে? তোমার সমস্ত সুখ দুঃখ তোমার স্ত্রী কখনই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন না।
জাফ। তাহা না পারুন; কিন্তু তিনি আমার মতের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। আমি যদি দিনকে রাত্রি বলি, তিনিও বলেন,-“হা, দিব্য জ্যোৎস্না।” আবার যদি আমি অমাবস্যা রাত্রিকে দিন বলি, তিনিও বলিবেন,-“হ্যা, রৌদ্র বড় প্রখর।”
গও। সাবাস! (সকলের হাস্য)
জাফ। তা’ না ত কি! স্বামী-স্ত্রীর মত এক না হইলে দিবানিশি রুষ-জাপান যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিতে হয়।
গও। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মত এক হইল কই? তুমি যেরূপ বলিলে তাহাতে কেবল তোমারই মত প্ৰকাশ পায়, তাঁহার ত মতামত জানাই যায় না। তিনি কদাচ নিজ মত ব্যক্তি করেন না। এবার যখন কোন পশুশালায় যাইবে অনুগ্রহ করিয়া পশুগুলির সমক্ষে কোন বিশেষ মত প্রকাশ করিও, আর পশুগুলি উত্তর না দিলে বা মাথা নাড়িলে বুঝিয়া লইও, পশুগণ তোমার সহিত একমত হইয়াছে।