গও। স্ত্রীলোকেরা আমাদের অনুপযুক্ত কথার প্রতিবাদ করেন, আমাদের গল্পের অংশ গ্রহণ করেন, ইহা ত অতি সুখের বিষয়।
জাফ। তুমি এখন মুর্থ।–তোমারই পক্ষপাতিত্ব করিয়া নূরুকে ধমক দিলাম, আর তুমি উল্টা আমারই কথার প্রতিবাদ করা?
গও। প্রবলের পক্ষ সমর্থনের আবশ্যকতা নাই। তুমি তোমার ভগিনীর পক্ষপাতিতা করিবে, ইহাই স্বাভাবিক এবং সমুচিত। .
নূর। ভাই আমার মত বা পক্ষ সমর্থন করিবেন কেন? আমি বেচারী তাহার কি কাজে লাগি?-আমি কি তাঁহাকে মোকদ্দমায় সৎ পরামর্শ দিতে পারি? আমি কি তাঁহার জমীদারী দাঙ্গার সময় পাঁচ সাত জন লাঠিয়াল পঠাইয়া সাহায্য করিতে পারি?
গওহর হাসিলেন। জাফর অন্য কথা তুলিলেন;–
“সত্যই নূরু এবার আমার সঙ্গে যাইবে না? আমি ভাবিয়ছিলাম, আগামী বৎসর যাইতে পরিবে না, তখন কাওসরুর বিবাহের ধূমধামে ব্যস্ত থাকিবে। এবার যাইবে না কেন? তুমি গুরুজী এই শিক্ষা দিয়াছ না কি?”
আবার প্রবলবেগে হাসি পাওয়ায় বালিকাদল পলয়ান করিল।
গও। দোহাই তোমার! আমি কিছু শিক্ষা দিই নাই। উনি ত প্রতি বৎসর তীর্থদর্শনের ন্যায় তোমার সহিত পিত্ৰালয়ে যাইতেন। এবার কেন। যাইতে অনিচ্ছুক, উহাকেই জিজ্ঞাসা কর।
জাফ। বল নূরু! কোন যাইবে না?
নূর। আমি রাবুদের ডাউহিল স্কুলে ভৰ্ত্তি করিবার চেষ্টায় আছি।
স্কুল শব্দ শুনিবা মাত্র জাফর বিস্ময়ে চমকাইয়া উঠিলেন,-“কি বলিলে? স্কুলে মেয়ে ভৰ্ত্তি করিবে? এখনও ভারত হইতে মুসলমানের নাম বিলুপ্ত হয় নাই—এখনও মুসলমানসমাজ ধ্বংস হয় নাই! এখনই মেয়েরা স্কুলে পড়বে? এ প্রথম অভিশাপ আমারই ভাগিনেয়ীদের উপর? প্ৰথম অধঃপতন আমাদেরই?”
গও! তুমি ভালরূপে কথাটা না শুনিয়াই বিলাপ আরম্ভ করিলে? ডাউহিল স্কুলে কেবল বালিকারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে সাত আট জন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত আছেন। তথায় পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাদৃশ বিদ্যালয়ে কন্যা পাঠাইলে দোষ কি?
নূর। সে স্কুলে পুরুষ মোটেই নাই। মেথরাণী ও আয়াই স্কুল গৃহের যাবতীয় কাৰ্য্য করে। কেবল বাবৰ্চি ও খানসাম্য পুরুষ। পাচকের সঙ্গে স্কুলগৃহের কোন সম্বন্ধ নাই। কেবল রন্ধনশালা হইতে খানা বহিয়া আনে দুই তিনজন চাকর। প্রধানা শিক্ষয়িত্রীর সহিত আমি কথা ঠিক করিয়াছি যে ঐ খাদ্যদ্রব্য বহিবার জন্য যদি আমি উপযুক্ত চাকরাণী দিতে পারি, তবে তিনি তাহাদিগকেই নিযুক্ত করিয়া পুরুষ কয়টিকে বরখাস্ত করিবেন। উক্ত শিক্ষয়িত্রীটি অতিশয় ভদ্রলোক-তিনি আমাদের পর্দার সম্মান করিয়া থাকেন। সমস্ত স্কুলটি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিলাম,-কোথাও একটিও চাকর ছিল না।
জাফ। তোমরা বল-আমি শুনি!! আর ঐ স্কুলের পাশ্বেই যে বালকদের স্কুল। ছুঢ়ীর সময় বালক বালিকারা একত্রে খেলা করিবে
গও। বালক স্কুল হইতে বালিকা স্কুলের ব্যবধান এক মাইলেরও অধিক; এমত স্থলে তাহারা একত্ৰে খেলিবে কিরূপে?
জাফ। যদি তোমার চক্ষে কোন পীড়া না হইয়া থাকে। তবে ষ্টেশনের নিকট দাড়াইলেও দেখিবে,-উভয় স্বৰূলের চূড়া পাশাপাশি।
নূরজাহী হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। গওহর সহাস্যে বলিলেন, “তোমার অভিজ্ঞতার বলিহারি যাই! আজি তুমি ভিক্টোরিয়া স্কুল পরিদর্শন করিয়া এই অভিজ্ঞতা অৰ্জ্জন করিয়াছ?”
জাফ। আমি স্কুলের ভিতর যাই নাই।
গও। (সবিস্ময়ে) তবে সকালে তিন ঘণ্টা তমি কোথায় ছিলে?
জাফ। তৃতীয় বেঞ্চে কতকক্ষণ বসিয়াছিলাম। তারপর স্কুল সীমানায় প্রবেশ করিয়া দেখি, পথ আর ফুরায় না। একজন পথিককে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, স্কুল পৌঁছতে আরও ১৫ turn (পেচ) বাকী। (অর্থাৎ পথত সোজা নহে, আঁকাবঁকা; তাই আরও ১৫ বার মুক্সিল স্থা পুঞ্জয়া যাইবে)। তখন আমি ভাবলাম, আজি আর পথ শেষ হইবে না, তাই ফিরিয়া আসিলাম।
নূরনহাঁ আবার হাসিলেন। আর গওহর বলিলেন, “বাস! মোল্লার দৌড় মসজিদ পৰ্য্যন্ত! তুমি প্রায় স্কুলের দ্বারদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ, ভিক্টোরিয়া অথচ ডাউহিল স্কুল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছ। তুমি কি জান ब्लिन् কোথায়? স্কুলগৃহের যে যুগল চূড়া দেখা যায়, উহা এক ভিক্টোরিয়া স্কুলেরই। স্কুলটি কি তুমি সামান্য গ্রাম্য পাঠশালা মনে করিয়াছ? উহা এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা,–এবং উহা অনেকখানি স্থান ব্যাপিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বালকদের জীড়া প্রায়শই ত প্রায় পাঁচ বিঘা জমী!
নূর। এবং ডাউহিল স্কুল উহা অপেক্ষাও প্রকাণ্ড। একটি কক্ষে পঞ্চাশটি বালিকার শয্যা দেখিলাম; এবং প্রত্যেক পর্য্যঙ্ক অপর পর্য্যঙ্ক হইতে দুই হাত ব্যবধানে। এখন আন্দাজ কর ত কক্ষটা কত বড়?
জাফ। অতবড় ঘর এ প্রস্তরসঙ্কুল দেশে নির্ম্মাণ করা কি সহজ না সম্ভব?
নূর। সহজ না হউক সম্ভব তা বড় বড় অট্টালিকা নিৰ্ম্মিত হইয়াছে তা। প্রথমে একটা টেনিস কোর্ট দেখিয়া আমার চক্ষে ধাধা লাগিয়াছিল। কতগুলি কঠিন প্রস্তরের মস্তক চূর্ণ করিয়া ঐ সমতল প্রাঙ্গণখনি নিশ্চির্মত হইয়াছে, তাহা আমরা সহজে ধারণা করিতে পারি না। কেবল প্রস্তর ভাঙ্গিতে হয় নাই, স্থানবিশেষে জোড়া দিয়া ভরাটও করিতে হইয়াছে। অতখানি স্থান যে একেবারে গৰ্ত্তশূন্য ছিল, তাহা হইতে পারে না। একদিকে মহাশিল্পীর পর্বত-রচনা কৌশল, অপর দিকে তাঁহারই প্রদত্ত মানববুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ-উভয়ের মিশামিশি বড় চমৎকার বোধ হয়।