কও। হঁয়; এবং এখন আবার উপযুক্ত উত্তাপে বাপীভূত হইতে পারে।
রাবু। তবে সূর্যোত্তিাপে গলিয়া যায় না কেন?
কও। গলে বইকি? ঐ বরফ অল্প উত্তাপে স্থানভ্রষ্ট হইয়া নদীর মত বহিয়া যায়; তাহাকে ইংরাজীতে “গ্লেসিয়ার” বলে। আব্বা উহার নাম দিয়াছেন “নীহারনদী”।
রাবু। বাঃ! বরফের নদী ত বড় সুন্দর দেখাইবো! চল আমরা একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘার নিকট গিয়া নীহারানদী দেখিয়া আসি।
বদ। বটে? কাঞ্চনজঙ্ঘা বুঝি খুব নিকট?
রাবু। নিকট না হউক, আমরা কি পথ চলিতে ভয় করি? একদিন চিমনী সাইডে উঠিয়াছিলাম–তাহা কি অল্প পথ ছিল? পাচ ছয় মাইল আরোহণ ও অবতরণ কি সামান্য ব্যাপার? আবার সেদিন ডাউহিল ও ঈগলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলে নামিয়াছিলাম।
বদ। ডাউহিলের সন্ধিস্থলে অবতরণ করিয়া কেমন ক্লান্ত হইয়াছিলে, মনে নাই?
কও। রাবুত বলিয়াছিল, আমি আর হাঁটিতে পারি না; আমাকে ফেলিয়া যাও! আমায় ভল্লুকে খায় খাইবে!
রাবু। ডাণ্ডিটা(৭) সময়ে না পাওয়া গেলে আসিতেই পারিতাম না।
কও। আব্বাই ডাণ্ডির বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন, অৰ্দ্ধপথে বন্দু ও রাবুর বীরত্ব প্রকাশ পাইবে!
বদ। আমি ত ভাই রাবুর মত অহঙ্কার করি না যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৰ্যন্ত পদব্ৰজে যাইতে পারিব, একদৌড়ে দ্বিতীয বেঞ্চ অতিক্রম করিব। হাঁ, ভাল কথা! আমি যে সেই ঈগেলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলের বিজন অরণ্য হইতে ফুল আনিয়াছিলাম, তাহা কোথায় রাখিয়াছি? মনে ত পড়ে না।
কও। ফুলগুলি বনে ফিরিয়া গিয়া থাকিবে।
বদ। তবে তুমি তুলিয়া রাখিয়াছ! আর ভাবনা নাই।
কও। তোমার ফুল কিরূপ ছিল? আমার সংগৃহীত কুসুমরাজি হইতে তাহা বাছিয়া লাইতে পার?
বদ। বেশ পারি—সে ফুল বকুল ফুলের মত। গন্ধ ও আকৃতি বকুলের, কেবল বর্ণ পীত।
রাবু। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর যে ক্রেপের ওড়নার মত পাতলা মেঘের গাঢ়গোলাপী বেগুনী চাদর দেখিতে পাই, তাহা কোথা হইতে আইসে?
কও। সূৰ্য্যের উত্তাপে ঐ জমাট তুষার হইতে যে বাষ্প উখিত হয়, তাহাই মেঘের ওড়না রূপে কাঞ্চনের চুড়া বেষ্টন করিয়া থাকে।
আখ। আমি ভাবিয়াছিলাম, কাঞ্চনের ওড়নাগুলি বানারস হইতে আইসে!
সুরেয়া ধীরে ধীরে কওসরের নিকট আসিয়া বলিল, “বড়। আপা! আমাকে ইন্দ্ৰধনু দিবে না?”
কও। (সুরেয়ার মুখ চুম্বন করিয়া) আমি কাল তোমায় ইন্দ্ৰধনু দিব।
বদ। সে কি! তুমি ইন্দ্ৰধনু ধরিবে কেমন করিয়া?
কও। ঝাড়ের কলমে (ক্রিকোণ কাঁচ খণ্ডে) ইন্দ্ৰধনু দেখা যায় তা জানিস না?
বদ। তবে ত ইন্দ্ৰধনু ধরিয়া দেওয়া বড় সহজ! হা হা!
আখ। বড় আপা যে “কম্পতরু”! তিনি দিতে না পারেন কি?
কও। “কল্পতরু নহে’,-“কল্পলতা” বলিতে পার!
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
অপরাহ্নে নূরজাহী চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া জাফর ও গওহরের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।
মাতার অঞ্চল ধরিয়া মুশতরী বলিল, “কেন মা, আজি এখন কেন আমরা বেড়াইতে বাহির হইব না?”
নূরজাহঁ। সকালে তোদের মাম্মা ভিকাটারীয়া স্কুল দেখিতে গিয়াছিলেন, এখন তিনি বিশ্রাম করিবেন। তাঁহাকে এক রাখিয়া আমরা কিরূপে যাইব?
জোহরা। কেন? মাম্মা একা থাকিতে ভয় করিবেন না কি? তুমি না যাও, আমরা আকরার সঙ্গে যাইব।
কৰ্ত্তা সে কক্ষে প্রবেশ করিবা মাত্র মুশতরী ও জোহরা তাহাদের দরখাস্ত পেশ করিল। গুণাবলিলেন, “বেণ চল— অধিক দূৰ যাইব না, কেবল ঈগেলস, ক্রেগে গিয়া ফিরিয়া আসি।
জোহ। না, আব্ববা। ঈগেলস, ক্রেগ না! সে দিকে বড় জোঁক।
মুশ। না, ও জোঁকের ক্ষেত্রে গিয়া কাজ নাই।
গও। ছি! তোরা জোঁক দেখিয়া ভয় করিস? (জাফরের পদ শব্দ শুনিয়া) আচ্ছা চুপ কর! তোদের মাম্মাকেও লইয়া যাইব। তাঁহাকে অগ্ৰে যাইতে বলিয়া আমরা পশ্চাতে থাকিব।
জোহ। (আনন্দে করতালি দিয়া) সে বেশ হইবে! পথে জোক থাকিলে পূৰ্ব্বে তাঁহাকে ধরিবে।
মুশ। চুপ চুপ! মাম্মা !–
ইতঃমধ্যে জাফর আসিয়া চায়ের টেবলে যোগদান করিলেন।
গও। ভাই! আজ আর একটু বেড়াইবে না?
জাফ। না, আমার পা বড় ব্যথা করিতেছে।
গও। তবু আজ একটু না হীটলে কাল তুমি একেবারে খোড়া হইয়া যাইবে। বেশী নহে— চল এই ঈগেলস, ক্ৰেগ পৰ্য্যন্ত।
জাফ। আমি যে বুট পরিতে পারিব না।
গও। বুট পরিবার দরকার কি, শ্লিপার লইয়াই চল না? সে ত প্রস্তরসঙ্কুল পথ নহে; ঘাসের উপর চলিবে।
রাবু (জনান্তিকে) শ্লিপর পরিয়া গেলে জোক ধরিবার পক্ষে সুবিধা হইবে। (বালিকাদের হাস্য)।
জাফ। (বালিকাদের প্রতি) ছি! হাসিস কেন? তোরা বড় বে-আদব। কেন নূরু, তুই কি একটা ধমক দিতেও পারিস না?
নূর। দোষ বুঝাইয়া না দিলে ওরা ধমক মানে না।
গও। বিনাদোষে বিনাকারণে ধমক মানিবেই না কেন? হাসিলে দোষ কি?
জাফ। বাস। গওহর, তুমিই মেয়েদের মাথায় তুলিয়াছ।
গও। আচ্ছা, এখন তোমার যাওয়া ঠিক হইল ত?
জাফ। না-পথ কি বড় ঢালু? উপরে উঠতে হইবে, না, নীচে যাইতে হইবে?
গও। পথত একটু ঢালু হইবেই-এখানে সমতল স্থান কোথা পাইবে?
জাফ। তবে আমি যাইব না-এ প্ৰকাণ্ড শরীর লইয়া গড়াইতে চাই না!
গও। ছি! তুমি পাথুরে পথকে ভয় কর, ঢালুপথে গড়াইতে চাও না,-ইহা তোমার womanishness (স্ত্রীভাব)।
নূর। “womanish” শব্দে আমি আপত্তি করি। “ভীরুতা’ কাপুরুষতা” বল না কেন?
জাফ। পিপীলিকার পক্ষ হইলে শূন্যে উড়ে। স্ত্রীলোকে শিক্ষা পাইলে পুরুষদের কথার প্রতিবাদ করে,-সমালোচনা করে। তুমি কি গওহরকে ভাষা শিক্ষা দিবে?