আখতার। আমরা সেখানে গেলে মাম্মা গজ্জন ছাড়িয়া গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিবেন।
বদর। আমরা তাহার সম্প্ৰমুখে যাইব না-পাশ্বের ঘরে লুকাইয়া শুনিব।
কওসর। ছি বদু! লুকাইয়া কিছু শুনা উচিত নহে; সাবধান!
বদর। (ব্যগ্রভাবে।) তবে আমি যে দুই একটি কথা শুনিয়া ফেলিয়াছি, তাহার উপায় কি?
কও। যাহা হইবার হইয়াছে। আর কখন এরূপ দোষ করিও না।
আখ। মাসুমা ত ঘুমাইয়াছে; যাও নায়িমু! তুমিও ঘুমাও গিয়া।
নমিয়া। না, আমি ধুম্না।(৫)
আখ। তবে আমি আর তোমায় কোলে রাখিব না!
কও। চল এখন আমরা পড়াশুনা করি গিয়া। যাও ত বোন মুশতরী, তুমি দেখিয়া আইস, আমাদের পড়বার ঘরে অগ্নিকুণ্ডে কয়লা, আগুন —সব ঠিক আছে কি না।
জোহরা। আমরা ডাউহিল স্কুলে পড়তে গেলে খুব ছুটী পাইব, না?
আখ। আরে! আগে যা ত ডাউহিল স্কুলে, তারপর ছুটী লইস।
বদর। আগে পাগলা ঝোরার(৬) জলে ভাল করিয়া মুখখানা ধো!
রাবু। কেন আপা! আমাদের স্কুলে যাওয়া হইবে না কেন? তোমরাই তিনজনে যাইবে না-তোমরা বড় হইয়াছ। আমরা কেন যাইব না?
কও। ওরে, মাম্মা যাইতে দিলে হয়!
রাবু। মাম্মাটা ভাললোক নহেন,-তাহার চক্ষু দেখিলে আমার যে ভয় হয়! এখন তিনি আসিয়াছেন, কেবল আমাদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা দিতে!
সুরেয়া। আমি ত স্কুলে যাইবই—
জোহ। হাঁ, তুই একাই যাইবি-তুই বড় সোহাগের মেয়ে কি না!
বদ। রাবু! তোরা পাগলা কোরার নিম্পর্মল জলে বেশ ভাল করিয়া মুখ ধুইস! আমরা তিনজন টেকনিকাল স্কুলে ভর্ত্তী হইব।
রাবু! তোমাদের মাম্মা বাধা দিবেন না?
কও। বাধা দিয়াছিলেন; এখন রাজী হইয়াছেন।
জোহ। আপা! সেখানে কেবল ‘নানা’ আছে, ‘নানা’ নাই?
বদ। না, সে স্কুলে ‘নানা’ নাই—কেবল একদল ‘নানী’ আছেন!
এখানে ‘নানা’ অর্থে নান শব্দের পুংলিঙ্গ বুঝিতে হইবে। দুষ্ট বালিকারা সেন্ট হেলেনাস টেকনিকাল স্কুলের নানুদিগকে ‘নানী’ বলে! তা তাহাদের সূতি খুন মাফ!! এই স্কুলে বালিকাদিগকে রন্ধন, সূচিকম্পর্ম ও নানাপ্রকার বুনন গাঁথনি (যাবতীয় ফ্যানসী ওয়ার্ক) শিক্ষা দেওয়া হয়।
জোহরা সাদরে আখতরের হাত ধরিয়া বলিল, “আপা! তুমি আমার পুতুলের জন্য খুব সুন্দর শাল তৈয়ার করিয়া দিও?”
সুরেয়া কওসরের কণ্ঠবেষ্টন করিয়া বলিল, “আর তুমি অনেক মিঠাই তৈয়ার করিও।”
রাবু। হাঁ, তাহা হইলে তুমি খুব মিঠাই খাও! (সকলের হাস্য)।
মুশতরী আসিয়া জানাইল পাঠগৃহে সব প্রস্তুত। অতঃপর সকলে সেই কক্ষে গেল।
কওসর শিক্ষয়িত্রীর আসন গ্ৰহণ করিয়া গভীর ভাবে সকলকে সম্বোধন করতঃ বলিল, “আব্বা যে সন্ধ্যার সময় আমাদিগকে বায়ুর বিষয় বলিলেন, তাহার কোন কথা তোমরা কে বুঝিতে পার নাই? যে না বুরিয়া থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা কর, আমি বুঝাইয়া বলি।”
মুশ। আব্বা হওয়ার কথা বলিয়াছেন। ইন্দ্ৰধনুর বিষয় ত কিছু বলেন নাই। আমি কালি তাহাকে ইন্দ্ৰধনুর কথা জিজ্ঞাসা করিব।
জোহ। আমি আব্বাকে বলিব, আমায় একটা ইন্দ্ৰধনু আনিয়া দিতে।
সুরে। আমিও ইন্দ্ৰধনু লইব।
বয়োজ্যেষ্ঠার হাসিল। মুশতরী বলিল, “ওরে, ইন্দ্ৰধনু কি ধরা যায়?”
রাবু। ইন্দ্ৰধনু ধরা যায় না। সত্য,-কিন্তু যে উপায়ে বায়ু ধরিয়া কাচের নলে বন্ধ করা যায়, পরীক্ষা করা যায়, সেইরূপে ইন্দ্ৰধনুকে ধরাও অসম্ভব নহে।
কও। এ অকাট্য যুক্তি! (সকলের হাস্য)।
রাবু। কেন, মন্দটা কি বলিলাম? আখ। না রাবু! কিছু মন্দ বল নাই। টেলিফোন, গ্রামোফোন-ফনোগ্রাফ ইত্যাদিতে মানুষের কণ্ঠস্বর ধরা গিয়াছে ও ধরা যায়, তবে ইন্দ্ৰধনু ধরা আর শক্তটা কি?
আবার হাসির গররা উঠিল।
কও। চুপ! চুপ! মাম্মা শুনিলে বলিবেন, “এইরূপে বুঝি পড়া হইতেছে?”
মুশ। (কষ্টে হাস্য সম্বরণ) আব্বা তা আমরা হাসিলে কিছু বলেন না?
রাবু। না, বরং তিনিও হাসেন।
বদ। তোরা আর এক কথা শুনিয়াছিস? জাহেদ ভাই ও হুরন বুকে মাম্মা প্রহার করিয়া থাকেন!
জোহ। সত্য নাকি? বাবা! তবে আর আমি মাম্মার বাড়ী যাইব না। যখন নিজের ছেলে মেয়েকে মারেন, তখন আমাদের ত আরও মারিবেন।
সুরে। আব্বা তা আমাদের কখনও মারেন না।
রাবু। আমাদের আকরা ভাল, মাও ভাল, কেবল মাম্মাটি ভাল নহেন।
বদ। দাড়া! আমি মাম্মাকে বলিয়া দিব!
আখ। রাবুতাঁহার মুখের উপর বলিতে ভয় করে কবে?
কওসর। বাস্! এখন চুপ কর!
বদ। বায়ুর বিষয় ভালরূপ বুঝিলাম কি না, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন কর না, বড়। আপা?
কও। আমি কাল দিনের বেলায় মেঘমালা দেখিযা ও দেখাইয়া প্রশ্ন করিব। তোমরা এখন
আমাকে প্রশ্ন করিয়া ভাল করিয়া বুঝিয়া লও।
রাবু। আমি কাল পেটাশিয়াম জলে ফেলিয়া তামাসা দেখিব।
মুশ। পেটাশিয়াম জলে ফেলিলে কি তামাসা হইবে?
বদ। কেন তোমার মনে নাই?-উহা জলে ফেলিবামাত্র আগুন জ্বলিয়া উঠিবো!
মুশ। হাঁ, মনে পড়িল। আমি খেলা করিব, সোডিয়াম ও গরমজল লইয়া।
নায়িমা। (নিদ্রাবেশে চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে) আল আমি? আমি তি থেলিব?
মাধ। সেহাস্য) তোমার এখন ‘থেলিয়া’ কাজ নাই। চল, তোমায় শয্যায় রাখিয়া আসি।
রাবু। মুশতরী! তোমার আগুন অপেক্ষা আমরা আগুনের রঙ বেশী সুন্দর হইবে!
মুশ্। কেন? সোডিয়াম গরম জলে ফেলিলে বেশী সুন্দর হলদে রঙের আগুন বাহির হইবে?
কও। তোমরা ঝগড়া ছাড়া আর কিছু জান না? রাবুই বড় দুষ্ট-ওই ঝগড়া আরম্ভ করে!
রাবু। ক্ষমা কর, বড় আপা। এখন কাজের কথা বলি। আমরা যে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় তুষার দেখি, উহাও কি পূৰ্ব্ব অবস্থায় বায়ু ছিল?