–ডা. ববীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“সকলে তাঁরেই ডাকে,
আমি যাঁরে ডাকি,–
রাঙ্গা রবি নিয়া বুকে
ঊষা ডাকে সোণামুখে
গোধূলি বালিকা ডাক
শ্যাম ছটা মাখি।”–
–মানকুমারী দেবী।]
আর, একই স্থান হইতে আমরা আসিয়াছি এবং সেইখানে পুনরায় যাইতেছি। ইহার ফল এই হইবে যে, একে অপরের সহিত নিতান্তু আন্তরিক ও প্রকৃত ভ্ৰাতৃভাবে মিশিতে পরিবে। একের দুঃখে অপারে দুঃখিত হইবে-সমুদয় ভারতবাসী একই জাতি বলিয়া পরিগণিত হইবার অধিকার প্রাপ্ত হইবে। অধিকন্তু জগতের বড় বড় শক্তিপূঞ্জ ভারতসন্তানকে একজাতি বলিয়া স্বীকার করিবে। যখন হিন্দু মুসলমানে, পারসী-খ্ৰীষ্টানে, জৈন-য়ীহুদীতে এবং বৌদ্ধশিখে প্ৰেমপূৰ্ণ হৃদয়ে আলিঙ্গন হইবে, তখন আমি মনে করিব যে, ধর্ম্মের জয় এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের পবিত্র নাম শান্তিপ্রদ হইয়াছে।
অদ্য আমি ইসলাম-সম্বন্ধে দুই চারি কথা বলিব এবং আগামী কল্য ও পরশ্ব অবশিষ্ট দুই ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে, এবং অনন্তর সমুদয় ধৰ্ম্মের প্রকৃত মৰ্ম্ম-সারতত্ত্ব অর্থাৎ সেই থিয়োসকী (ব্ৰহ্মজ্ঞান বা “এলমে-এলাহী”) সম্বন্ধে আলোচনা করিব, যাহাতে প্ৰত্যেক ধৰ্ম্মবিশ্বাসের সারভাগ আছে এবং যাহা সকলের উপর একই প্রকার অধিকার রাখে-যাহাকে কোন বিশেষ ব্যক্তি তাহার নিজস্ব বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ধৰ্ম্ম বলিতে পারে না; বরং তদ্বিপরীত যে কোন ধৰ্ম্মবিশ্বাসের অধিকারী বলিতে পারে যে, ইহাই আমারও ধৰ্ম্ম। আদ্য সমিতির সম্ববাৎসরিক অধিবেশন দিনে আমার এই প্রার্থনা যে, বিশ্ব-সংসারের সমুদয় ধৰ্ম্মগুরুদের পবিত্ৰ-আত্মা আমাদের ও আমাদের কাৰ্যকলাপের প্রতি র্তাহাদের আশীৰ্ব্বাদপূর্ণ দৃষ্টিপাত করুন-যেন তাহাদের শিষ্যমণ্ডলী একজন অপরকে ভাল বাসিতে পারেন। আমীন!
ইসলাম
কোন ধৰ্ম্ম পরীক্ষা করিতে হইলে, আমাদিগকে চারিটি বিষয় সম্পবন্ধে চিন্তা করিতে হয়। সৰ্ব্বপ্রথম সেই ধর্ম্মের উৎপত্তির ইতিহাস, যাহার প্রভাব তাঁহাতে (সেই ধর্ম্মে) লুক্কায়িত থাকে। দ্বিতীয়, তাহার প্রকাশ্য বা বাহ্যিক মত অথবা শাখা পল্লব, যাহার সহিত সাধারণে সম্পর্ক রাখে। তৃতীয়, ধৰ্ম্মের দর্শন, যাহা বিদ্বান এবং সুশিক্ষিত লোকদের জন্য। চতুৰ্থ, ধর্ম্মের গৃঢ় রহস্য, যাহাতে সাধারণতঃ মালবের আপনি অহং বা অস্তিত্বজ্ঞানের ভাণ্ডারের সহিত মিশিবার স্বাভাবিক ইচ্ছা প্ৰকাশ পায়। আমি এই কষ্টিপাথরে ইসলামকে পরীক্ষা করিয়া আপনাদিগকে দেখাইতে চাই যে, সৰ্ব্বপ্রথমে আরব ও শামদেশের অবস্থার প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া দেখুন, সে দেশের কি দশা ছিল।
খ্ৰীষ্টীয় যষ্ঠ শতাব্দীতে যখন সমস্ত আরব, শাম ও আজমদেশে অসভ্যতার ঘোর অন্ধকারে কুসংস্কারের প্রবল ঝঞ্চানিল বহিতেছিল; যুদ্ধকলহ ও পরস্পরের রক্তারক্তি এক দলকে অন্য দল হইতে পৃথক করিতেছিল; হিংসা দ্বেষ এমন প্রবল ছিল যে, একই বিষয়ের ঝগড়া কয় পুরুষ পৰ্যন্ত চলিত;(1) যথা এক ব্যক্তি কোন বিষয় লইয়া অন্য একজনের সহিত বিবাদ করিল, অনন্তর শত বৎসর পরে একের পৌত্র অপরের পৌত্রকে শুধু এই অজুহাতে হত্যা করিত যে, “ইহার পিতামহ আমার পিতামহের শত্রু ছিল!” ইহা সেই আরব দেশসেখানে কেবল এই কথায় যুদ্ধ আরম্ভ হইত যে, “তোমার উষ্ট্র আমার উষ্ট্রকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইল কেন?” বাস, এই সামান্য কারণে রক্তনদী প্রবাহিত হইত-শবরাশি স্তূপীকৃত হইত! এ সেই আরব দেশ-যেখানে নিষ্ঠুর পিতা, মাতার ক্রোড় হইতে শিশু কন্যাকে কাড়িয়া লইয়া গৰ্ত্ত খনন করিয়া তাহাতে জীবন্ত প্রোথিত করিয়া আসিত। আর নিরুপায় মাতা আপন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহপূর্ণহৃদয়ের অসহ্য বেদনা লইয়া মরমে মরিয়া থাকিত। স্ত্রীলোক হওয়ার দরুণ পাষণ্ড স্বামীর ঐ নিম্পর্মম অত্যাচারে আপত্তি করিতে পারে, এতটুকু ক্ষমতাও তাহার ছিল না। কাহাকেও জামাতা বলিতে না হয়, এইজন্য কন্যা হত্যা করা হইত। ইহা সেই দেশ, যেখানে ঘূণিত পৌত্তলিকতা বিরাজমান ছিল—ঘরে ঘরে নতুন দেবতা; এক ঠাকুর আবার অন্য ঠাকুরের প্রাণের শত্রু। প্রতিমার সম্প্ৰমুখে নরবলিদান” ত নিত্য ক্রীড়া ছিল; যেখানে মানবজাতির প্রতি স্নেহ মমতার পরিবৰ্ত্তে বিলাসিতা ও আত্মপরায়ণতা পূর্ণ মাত্রায় রাজত্ব করিত। যে কোন প্রবল ব্যক্তি আপন দুৰ্ব্বল প্রতিবেশীকে বিনা কারণে কিম্বা অতি সামান্য কারণে হত্যা করিয়া ফেলিত; তাহার ঐ দুহিব্রুয়ায় বাধা দিবার লোক ত দূরে থাকুক, একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবারও কেহ ছিল না।
তদানীন্তন আরবে বিলাসিতার ও অন্যান্য “মকারাদি” কুক্রিয়ার অন্ত ছিল না; এক স্বামী ভেড়া ছাগল প্রভৃতি পশুর ন্যায় অসংখ্য ভাৰ্য্যা গ্ৰহণ করিত; আর এই বিষয়ে গীেরব করা হইত। যে অমুক ধনী ব্যক্তি এত অসংখ্য স্ত্রীর স্বামী। ঈশ্বরের সৃষ্টি-স্ত্রীজাতি এমন জঘন্য দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধা ছিল যে, তাহারা নিতান্ত অসহায় গৃহপালিত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করিত। মোটের উপর এমন কোন নিকৃষ্ট পাপ ও জঘন্য দোষ নাই, যাহা তৎকালীন আরবে না ছিল।
সেই স্বাৰ্থ, অত্যাচার ও আত্মপরতার পূতিগন্ধময় জলবায়ু পরিবেষ্টিত এক কোরেশগহে একটি শিশু (সে পবিত্র শিশুরত্নের উদ্দেশে সহস্র দরুদ!) জন্মগ্রহণ করিলেন, র্যাহার পিতা তাঁহার জন্মের কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই ইহধাম পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। আর তিনিও সেইরূপ পিতা ছিলেন, যিনি তদীয় পিতৃকর্তৃক কোন প্রতিমার সম্পমুখে নরবলিরূপে আনীত হইয়াছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ দেবালয়ের সেবিকার কৃপায়-সে যাত্রা রক্ষা পাইয়াছিলেন।(2) এই শিশু এমন একটি হতভাগিনী দুঃখিনী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ইনি ভূমিষ্ঠ হইবার পূৰ্ব্বেই বিধবা হইয়াছিলেন,-আর দারুণ বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কয়েক মাস পরেই এ অবোধ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিঃসহায় অবস্থায় ফেলিয়া স্বামীর অনুগমন করেন। ইহার ফলে এই পিতৃমাতৃহীন শিশু কিছুদিন স্বীয় পিতামহ কর্তৃক প্রতিপালিত হন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাহার পিতামহও কয়েক বৎসর পরে দেহত্যাগ করিলেন। তখন সেই অসহায় বালক বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পৰ্যন্ত, স্বীয় পিতৃব্য আবু তালেবের আশ্রয়ে রহিলেন। ইহা ত অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এইরূপ বিপদগ্ৰস্ত পিতৃমাতৃহীন সহায়সম্পদশূন্য একটি অজ্ঞান বালক যে শিক্ষাদীক্ষা হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকিবেন, ইহাই স্বাভাবিক। বাস্তবিক কাৰ্য্যতঃও তাঁহাই হইয়াছিল। শিক্ষা, বা অধ্যয়ন বলিতে একটি অক্ষরের সঙ্গেও তাঁহার পরিচয় হয় নাই, নীতি বা আচার নিয়মের অনুশাসনের বাতাস পৰ্যন্ত তাহাকে স্পর্শ করে নাই। তথাপি তাহার শৈশবকাল, অতি পবিত্র জীবনের উচ্চ আদর্শ ছিল। তাঁহার নিম্পর্মল জীবনে মানবের বাঞ্ছনীয় যাবতীয় সদগুণরাজিযথা, দয়া, সৌজন্য, প্রেম, ধৈৰ্য্য, নম্রতা, বিনয়, শান্তিপ্রিয়তা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি স্বভাবতঃ বিরাজমান ছিল। তিনি নানা গুণে সকলের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।