আখতার। রাবু একদৌড়ে যাইবে, না পথে বিশ্রাম করিবে, তাহা জানিবার উপায় কি?
গও। (বিস্ফারিত নেত্রে) জানিবার উপায়? রাবু যতদূর পর্যন্ত গিয়া ক্লান্তি বোধ করিবে, তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পরাজয় স্বীকার করিবে। সে নিজেই বলিবে, সে কতদূর গিয়াছিল। আমার কন্যা কি মিথ্যা বলিবে?
রাবু। (সোৎসাহে) না আব্বা! আমি মিথ্যা বলি না—বলিবও না।
আখ। আমি বেশ জানি, তুমি মিথ্যা বল না; তবে যদি মিথ্যা বাহাদুরির লোভে একটি ছোট মিথ্যা বলিয়া ফেলিতে!
রাবু। (সগৰ্ব্বে) মিথ্যা বলার পূৰ্ব্বে মরিয়া যাওয়া ভাল!
গও। ঠিক! তোমরা কেহ একটি মিথ্যা বলিলে আমার মর্ম্মে বড়ই ব্যথা লাগিবে। আশা করি, তোমরা কেহ আমাকে কখন এরূপ কষ্ট দিবে না।
কতিপয় বালিকা সমস্বরে বলিয়া উঠিল,–“আমরা মিথ্যা না,-আমরা কষ্ট না,” অথবা কি বলিল ঠিক শুনা গেল না!
এমন সময় সিঁড়িতে কাহার পদশব্দ শুনা গেল। কওসর ও মাসুমা ব্যতীত অপর বালিকা কয়টি “মাম্মা আসিলেন” বলিয়া পলায়ন তৎপরা হইল। গওহর নয়িমাকে ধরিয়া বলিলেন, “সেজন্য পলাইস কেন মা?”
নায়িমা। ও বাব্বা! আমি না-মাম্মা! (অর্থাৎ আমি থাকিব না-মাম্মা বকিবেন)। ইতঃমধ্যে জাফর আলী গৃহে প্রবেশ করিলেন। পলায়মানা বালিকাদের দেখিয়া গওহরকে সহাস্যে বলিলেন, “Solar system (সৌরজগৎ)টা ভাঙ্গিয়া গেল কেন?”২
গও। তুমি ‘ধূমকেতু আসিলে যে! নূরজাহী লাতার নিমিত্ত চা প্রস্তুত করিতে অগ্রসর হইয়া গওহরকে বলিলেন, “তুমি একটু সর, ভাইকে অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিতে দাও।”
জাফর। না। আমি অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিব না। যে ক্লান্ত হইয়াছি, আমার সর্বাঙ্গ ঘৰ্ম্মাসিক্ত হইয়াছে। আমি এইখানেই বসি।
কওসর জলখাবারের ট্রেটা আনিয়া জাফরের সম্প্ৰমুখে রাখিল, এবং তাঁহার ললাটে ঘৰ্ম্মবিন্দু দেখিয়া স্বীয় বসনাঞ্চলে মুছিয়া দিল।
জাফর এক পেয়ালা চা শেষ করিয়া ভগিনীর হস্তে পেয়ালা দিয়া বলিলেন, “নুরু। আর এক পেয়ালা চা দে!?
গও। তোমার ভুল হইল। পেয়ালাটি লইবার জন্য র্তাহাকে এতদূর আসিতে হইল, ইহা অন্যায়! তুমি উঠিয়া গিয়া তাহাকে পেয়ালা দিতে পারিতে!
নূরজাহাঁ অধোমুখে মৃদুহাস্য করিলেন। কওসরের খুব জোরে হাসি পাইল বলিয়া সে প্ৰস্থান করিল, এবং মাতার সাহায্যের নিমিত্ত বদরকে তথায় পাঠাইয়া দিল।
জাফ। দেখ ভাই! তোমার সাহেবীটা আমার সহ্য হয় না। তুমিই কি একমাত্র বিলাত ফেবতা?
গও। না, তুমিও বিলাত ফেরতা! তোমার গালি শুনিয়া আমোদ হয়, সেইজন্য সাহেবীভূতের দোহাই দিই! সে যাহা হউক, তোমার আসিতে এত বিলম্ব হইল কেন? পথে পাহাড়ীদের সহিত গলপ করিতেছিলে না কি?
জাফ। ভুটিয়াদের সহিত গল্প করিব কি, উহাদের ভাষাই বুঝি না; যে ছাই “কান্ছু যানছু” বলে!
বদর তাহার পাহাড়ী ভাষায় অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বলিল, “যানছুমানে যাওয়া।” নূরজাহাঁ তাহাকে বলিলেন, “ইহাদের গল্পে যোগ দিয়া তোমার কাজ নাই মা! যাও তুমি কওসরের নিকট।”
গও। তবে কেন বিলম্বব হইল?
জাফ। প্রথম বেঞ্চে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলাম। তথা হইতে সমস্ত কারসিয়ঙ্গ সহরটা ত বেশ দেখা যায়। বাজার ষ্টেশন, কিছুই বাদ পড়ে না।
নূরজাহী। হাঁ, ঐখানে বসিলে ধরা খানা সরা। তুল্য বোধ হয়!
গও। আর যেদিন ইহারা পদব্রজে “চিমনী সাইড”(৩) পৰ্য্যন্ত আরোহণ ও তথা হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন, সেদিন ইহাদের যে আনন্দ হইয়াছিল!-সম্ভবতঃ পোট আর্থার এবং বালটিক ফ্লট জয় করিয়াও জাপানীদের তত উল্লাস হয় নাই!!
নূর। জাপানীরা তত উল্লসিত হইবে কি রূপে? তাহাদের কার্য্য এখনও যে শেষ হয় নাই। আর আমরা ত পদবজে ১২ মাইল ভ্ৰমণের পর গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়ছিলাম!
জাফ। এখন বাকী আছে শ্ৰীমতীদের বেলুন আরোহণ করা!
গও। সময়ে তাহাও বাকী থাকিবে না!
জাফ। তুমি সপরিবারে ইংলণ্ড যাইবে কবে?
গও। যখন সুবিধা যাইবে!
জাফ। হঁ-কন্যাগুলি অক্সফোর্ড বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হইবে! সাধে কি তোমাদের সৌরজগৎ বলি। তোমার দুহিতা কয়টি গ্রহ, আর তুমি সূৰ্য্য! উহাদের নামও ত এক একটি তারকার নাম-মুশতরী, জোহরা, সুরেয়া!(৪) তবে কেবল মঙ্গল, বুধ, শনি এ নামগুলি বাধ দেওয়া হইয়াছে কেন?
নূর। ভাই! তোমরা নিজেরা ঝগড়া করিতে বসিয়া মেয়েদের নাম লইয়া বিদ্রপ কর কেন? আর এ নাম ত আমরা রাখি নাই, স্বয়ং কৰ্ত্তা রাখিয়াছেন। তাঁহার পৌত্রীদের নাম, তিনি যেরূপ ইচ্ছা রাখিবেন, তাহাতে আমাদের কিছু বলিবার অধিকার কি?
জাফরকে আরও অধিক ক্ষেপাইবার জন্য গওহর বলিলেন, “কেবল ইংলণ্ড কেন, আমেরিকা যাইবারও ইচ্ছা আছে,-কাওসর “নায়েগারা ফলস, দেখিতে চাহে।”
জাফ। তোমার এ সাধ অপূর্ণ থাকিবে। কাওসারকে আর ‘নায়েগারা” প্রপাত দেখাইতে হইবে না।
গও। কেন?
জাফ। আগামী বৎসর সে তোমার ক্ষমতার বাহির হইবে। গও। আমার হাতের বাহির হইলেই বা কি, জামাতাসহ যাইব।
জাফ। জামাতা তোমারই মত কাণ্ডজ্ঞানহীন মুর্থ হইলে ত?
গও! তুমি তাঁহাকে অধিক জান, না। আমি?
জাফ! আমি সিদ্দিককে যতদূর জানি, তাহাতে আশা রাখি, তিনি তোমার মত forward (অগ্রগামী) নহেন।
গও। আমিও আশা রাখি তিনি তোমার মত backward (পশ্চাদগামী) নহেন! তিনি নিশ্চয়ই কওসরকে নায়েগারা প্ৰপাত দেখাইবেন!
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
“মাম্মা আকরার সহিত তজ্জন গজ্জন করিতেছেন, চল আমরা শুনি গিয়া,” এই বলিয়া বদর আখতারকে টানিতে লাগিল।