মহারানি দূর হইতে ভগিনী সারাকে চিনিতা পারিয়া বলিলেন, ‘বা! আপনি এখানে।’ ভগিনী সারা রানিকে অভিবাদন করিয়া ধীরে ধীরে তখ্তে রওয়াঁ অবনত করিলে আমরা অবতরণ করিলাম।
আমি যথারীতি মহারানির সহিত পরিচিতা হইলাম। তাঁহার অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হইলাম। আমার আশঙ্কা ছিল, তিনি আমাকে কী যেন মন করিবেন, এখন সে ভয় দূর হইল। তাঁহার সহিত রাজনীতি সম্বন্ধে বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। বাণিজ্য-ব্যবসায় সম্বন্ধেও কথা উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন যে, ‘অবাধ বাণিজ্যে তাহার আপত্তি নাই, কিন্তু যে-সকল দেশে রমণীবৃন্দ অন্তঃপুরে থাকে অথবা যে-সব দেশে নারী কেবল বিবিধ বসন ভূষণে সজ্জিতা হইয়া পুত্তলিকাবৎ জীবনে বহন করে, দেশের কোনো কাজ করে না, তাহারা বাণিজ্যের নিমিত্ত নারীস্থানে আসিতে বা আমাদের সহিত কাজকর্ম করিতে অক্ষম। এই কারণে অন্য দেশের সহিত আমাদের বাণিজ্য-ব্যবসায় চলিতে পারে না। পুরুষেরা নৈতিক জীবনে অনেকটা হীন বলিয়া আমরা তাহাদের সহিত কোনোপ্রকার কারবার করিতে ইচ্ছুক নহি। আমরা অপরের জমিজমার প্রতি লোভ করিয়া দুই-দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না, অথবা একখণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না–যদ্যপি তাহা কোহেনুর অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ হয়, কিংবা কাহারও ময়ূরসিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞানসাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নবাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে আমরা তাহাই ভোগ করি। তাহাতেই আমরা সন্তুষ্টচিত্তে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিই।’
মহারানির নিকট বিদায় লইয়া আমি সেই সুপ্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় দেখিতে গেলাম, এবং কতিপয় কলকারখানা, রসায়নাগার এবং মানমন্দিরও দেখিলাম।
উপরোক্ত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ পরিদর্শনের পর আমরা পুনরায় সেই বায়ুযানে আরোহণ করিলাম। কিন্তু সেই আমাদের তখতে রওয়াঁখানি ঈষৎ হেলিয়া ঊর্ধ্বে উঠিতে লাগিল, আমি কী জানি কিরূপে আসনচ্যুত হইলাম–সেই পতনে আমি চমকিয়া উঠিলাম। চক্ষু খুলিয়া দেখি, আমি তখনো সেই আরামকেদারায় উপবিষ্ট।
———–
(১) “পরিস্থান” শব্দের অনুকরণে “নারীস্থান” বলা হইল। ইংরাজিতে “লেডি ল্যাণ্ড” বলা গিয়াছে।
(২) হিংসা বৃত্তিটা কি বাস্তবিক বড় দোষণীয়? কিন্তু হিংসা না থাকিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছা হয় কই? এই হিংসাই তো মানবকে উন্নতির দিকে আকর্ষণ করে। তবে দেশকাল ভেঙে ঈর্ষায় পতন হয়, সত্য। তা যে-কোনো মনোবৃত্তির মাত্রাধিক্যেই অনিষ্ট হয়; সকল বিষয়েরই সীমা আছে।
(৩) পুরুষ জাতিকে।
(৪) পাপ।
(৫) ইংরেজিতে ‘Travelling throne’ বলা যাইতে পারে।
সৌরজগৎ
কারসিয়ঙ্গ পৰ্ব্বতের একটি দ্বিতল গৃহে অপরাহ্নে গওহর আলী স্ত্রী ও কন্যাদলে পরিবেষ্টিত হইয়া অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়াছেন। তাঁহার নয়টি কন্যা যে ভাবে তাহাকে পরিবেষ্টন করিয়া বসিয়াছে, তাহা দেখিয়া স্বতঃই এ পরিবারটিকে সুখী ও সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে হয়। সৰ্ব্বকনিষ্ঠা দুহিতা মাসুমা তাহার। সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠ সহোদরা কওসরের ক্ৰোড়ে, এবং অবশিষ্ট শিশুগুলি পিতামাতার দুই পার্শ্বে ছোট ছোট পাদপীঠে বসিয়াছে।
এইরূপে ভাগ্যবান গহওর আলী তারকাবেষ্টিত সুধাংশুর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। কওসর পিতামহের অতি আদরের পৌত্রী। তিনি সাধ করিয়া ইহার নাম “কওসর” রাখিয়াছেন। কাওসর শব্দের অর্থ স্বগীয় জলাশয়, যেমন মন্দাকিনী।১
যে কক্ষে তাহারা উপবেশন করিয়াছেন, সেটি কতক মুসলমানী ও কতক ইংরাজী ধরণে সজ্জিত; নবাবী ও বিলাতী ধরণের সংমিশ্রণে ঘরখানি মানাইয়াছে বেশী। ত্রিপদীর (টিপায়ের) উপর একটি ট্রেতে কিছু জলখাবার এবং চা-দুগ্ধ ইত্যাদি যেন কাহার অপেক্ষায় রাখা হইয়াছে।
গওহর আলীর হন্তে একখানি পুস্তক; তিনি তাহা পাঠ করিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিতেছেন। তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় ছিল, বায়ু। বায়ুর শৈত্য, উষ্ণতা, লঘুত্ব, গুরুত্ব; বায়ুতে কয় প্রকার গ্যাস আছে; কিরূপে বায়ু ক্ৰমান্বয়ে বাষ্প, মেঘ, সলিল, এবং শীতল তুষারে পরিণত হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রোতৃবর্গ বেশ মনোযোগসহকারে শ্রবণ করিতেছে; কেবল সপ্তম দুহিতা সুরেয়া নানাপ্রকার প্রশ্ন দ্বারা পিতার ধৈৰ্য্যগুণ পরীক্ষা করিতেছে! কখনও ছবি দেখিবার জন্য পিতার হস্ত হইতে পুস্তক কাড়িয়া লইতেছে! পিতা কিন্তু ইহাতে বিরক্ত না হইয়া বরং আমোদ বোধ করিয়া হাসিতেছেন।
গৃহিনী নূরজাহাঁ একরার ঐ ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “ভাই এখনও আসিলেন না; চা ত ঠাণ্ড হইতে চলিল।”
গওহর। তোমার ভাই হয়ত পথে লেপচাদরের সঙ্গে খেলা করিতেছেন!
বালিকা। রাবেয়া বলিল, “আমরা তাঁহাকে দ্বিতীয় বেঞ্চের নিকট অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। এইটুকু পথ তিনি এখনও আসিতে পারিলেন না?”
সুরেয়া। বাব্বা! বেন কি অল্প পথ? আমি ত হাঁটিতে না পারিয়া আয়ার কোলে চড়িয়া আসিলাম।
রাবেয়া। ঈশ! আমি একদৌড়ে দ্বিতীয় বেঞ্চ হইতে এখানে আসিতে পারি।
গওহরও কন্যাদের কথোপকথনে যোগ দিয়া বলিলেন, “আগে এক দৌড় আসিতে পারিয়া দেখাও, পরে বড়াই করিও। কোন কাজ করিতে পারার পূৰ্ব্বে পারি’ বলা উচিত নহে!”
কওসর। এখান হইতে দ্বিতীয় বেঞ্চ প্রায় দুই মাইল হইবে, না আব্বা?
গও। কিছু বেশী হইবে। যাহা রউক, রাবু যখন বলিয়াছে, তখন তাহাকে অন্ততঃ একরার একদৌড়ে সে পৰ্যন্ত যাইতেই হইবে!