আমি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া বলিলাম, ‘যদি বারুদ দগ্ধকালে ভয়ানক দুর্ঘটনা হইয়া আপনাদের কোনো অনিষ্ট হইত!’
‘আমাদের অনিষ্টের সম্ভাবনা ছিল না, কারণ বারুদ ছিল বহুদূরে। আমরা রাজধানীতে থাকিয়াই সার্চলাইটের তীব্র উত্তাপ প্রেরণ করিয়াছিলাম। তবু অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য জলধর বেলুন সঙ্গে রাখা হইয়াছিল। তদবধি আর কোন প্রতিবেশী রাজা-মহারাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করিতে আইসেন নাই।’
‘তারপর পুরুষ-প্রবরেরা অন্তঃপুরের বাহিরে আসিতে চেষ্টা করেন নাই কি?’
‘হাঁ, তাঁহারা মুক্তি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কতিপয় পুলিশ কমিশনার ও জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে মহারানি সমীপে আবেদন করিয়াছিলেন যে, যুদ্ধে অকৃতকার্য হওয়ার দোষে সমর বিভাগের রাজকর্মচারীগণই দোষী, সেজন্য তাঁহাদিগকে বন্দি করা ন্যায়সঙ্গত হইয়াছে, কিন্তু অপর রাজপুরুষেরা তো কদাচ কর্তব্যে অবহেলা করেন নাই, তবে তাঁহারা অন্তঃপুর কারাগারে বন্দি থাকিবেন কেন? তাঁহাদের পুনরায় স্ব-স্ব কার্যে নিযুক্ত করিতে আজ্ঞা হউক।’
‘মহারানি তাঁহাদিগকে জানাইলেন যে, যদি আবার কখনো রাজকার্যে তাহাদের সহায়তার আবশ্যক হয়, তবে তাঁহাদিগকে যথাবিধি কার্যে নিযুক্ত করা হইবে। রাজ্যশাসন ব্যাপারে তাঁহাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত তাঁহারা যেখানে আছেন, সেইখানে থাকুন।
আমরা এই প্রথাকে ‘জেনানা’ না বলিয়া ‘মর্দানা’ বলি।’
আমি বলিলাম, ‘বেশ তো। কিন্তু এক-কথা–পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি তো ‘মর্দানায়’ আছেন, আর চুরি ডাকাতির তদন্ত এবং হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অত্যাচার অনাচারের বিচার করে কে?’
‘যদবধি ‘মর্দানা’ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে, তদবধি এদেশে কোনোপ্রকার পাপ কিংবা অপরাধ হয় নাই, সেইজন্য আসামি গ্রেফতারের নিমিত্ত আর পুলিশের প্রয়োজন হয় না–ফৌজদারি মোকদ্দমার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটেরও আবশ্যক নাই।’
‘তাই তো আপনারা স্বয়ং শয়তানকেই (৩) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, আর দেশে শয়তানি (৪) থাকিবে কিরূপে। যদি কোনো স্ত্রীলোক কখনো কোনো বেআইনি কাজ করে, তবে তাহাকে সংশোধন করা আপনাদের পক্ষে কঠিন নয়। যাহারা বিনারক্তপাতা যুদ্ধ জয় করিতে পারেন–অপরাধ ও অপরাধীকে তাড়াইতে তাঁহাদের কতক্ষণ লাগিবে?’
অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘প্রিয় সুলতানা! আপনি এখানে আরও কিছুক্ষণ বসিবেন, না আমার বসিবার ঘরে চলিবেন?’
আমি সহাস্যে বলিলাম, ‘আপনার রান্নাঘরটি রানির বসিবার ঘর অপেক্ষা কোনো অংশে নিকৃষ্ট নয়। কিন্তু কর্তাদের কাজ বন্ধ করিয়া এখানে আমাদের বসা অন্যায়; আমি তাঁহাদের যে-দখল করিয়াছি বলিয়া হয়তো তাঁহারা আমাকে গালি দিতেছেন।’
আমি ভগিনী সারা বসিবার ঘরে যাইবার সময় ইতস্তত উদ্যানের সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করিয়া বলিলাম–‘আমার বন্ধুবান্ধবেরা ভারি আশ্চর্য হইবেন, যখন আমি দেশে গিয়া নারীস্থানের কথা বলিল–নন্দনকাননতুল্য নারীস্থানে নারীর পূর্ণ আধিপত্য, যৎকালে পুরুষেরা মর্দানায় থাকিয়া রন্ধন করেন, শিশুদের খেলা দেন, এক-কথায় যাবতীয় গৃহকার্য করেন। আর রন্ধনপ্রণালী এমন সহজ ও চমৎকার, যে, রন্ধনটা অত্যন্ত আমোদজনক ব্যাপার। ভারতে যে সকল বেগম খানম প্রমুখ বড়ঘরের গৃহিণীরা রন্ধনশালার ত্রিসীমায় যাইতে চাহেন না, তাঁহারা এমন কেন্দ্রীভূত সৌরকর পাইলে আর রন্ধনকার্যে আপত্তি করিতেন না।’
ভারতের লোকেরা একটু চেষ্টা করিলেই সূর্যোত্তাপ লাভের উপায় করিতে পারেন। বিশেষ একখণ্ড কাচ (convex glass) দ্বারা যেমন রবিকর একত্রিত করিয়া কাগজাদি দগ্ধ করা যায়, সেইরূপ কাচবিশিষ্ট যন্ত্র নির্মাণ করিতে অধিক বুদ্ধি ও টাকা ব্যয় হইবে না।’
‘জানেন ভগিনী সারা। ভারতবাসীর বুদ্ধি সুপথে চালিত হয় না–জ্ঞানবিজ্ঞানের সহিত আমাদের সম্পর্ক নাই। আমাদের সবকার্যের সমাপ্তি বক্তৃতায়, সিদ্ধি করতালি লাভে। কোণো দেশ আপনা হইতে উন্নত হয় না, তাহাকে উন্নত করিতে হয়। নারীস্থানে কখনও স্বর্ণবৃষ্টি হয় নাই–কিংবা জোয়ারের জলেও মণিমুক্তা ভাসিয়া আইসে নাই।’
তিনি হাসিয়া বলিলেন, ‘না।’
‘তবেই দেখুন, ত্রিশ বৎসরে আপনারা একটা নগণ্য দেশকে সুসভ্য করিলেন আর প্রকৃতপক্ষে দশ বৎসরেই আপনারা এদেশকে স্বর্গতুল্য পুণ্যভূমিতে পরিণত করিতে পারিলেন। আর আমরা একটা সুসভ্য রত্নগর্ভা দেশকে ক্রমে উন্নত করিব দূরের কথা–বরং ক্রমশ তাহাকে দীনতমা শ্মশানে পরিণত করিতে বসিয়াছি।’
‘পুরুষের কার্যে আর রমণীর কার্যে এই প্রভেদ। আমি যে বলিয়াছিলাম পুরুষেরা কোনো ভালো কাজ সুচারুরূপে করিবার উপযুক্ত নয়, আপনি বোধ হয় এতক্ষণে সে কথাটা বুঝিতে পারিলেন।’
‘হাঁ এখন বুঝিলাম, নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শত শত বর্ষেও করিতে অক্ষম। আচ্ছা ভগিণী সারা, আপনারা ভূমিকর্ষণাদি কঠিন কার্য করেন কিরূপে?’
‘আমরা বিদ্যুৎসাহায্যে চাষ করিয়া থাকি। চপলা আমাদের অনেক কাজ করিয়া দেয়–ভারী বোঝা উত্তোলন ও বহনের কার্যও সে-ই করে। আমাদের বায়ুশকটও তদ্দ্বারা চালিত হয়। দেখিতেছেন, এদেশে রেল-বর্ত্ম বা পাকা বাঁধ সড়ক নাই, কেবল পদব্রজে ভ্রমণের পথ আছে।’
‘সেইজন্য এখানে রেলওয়ে দুর্ঘটনার ভয় নাই–রাজপথেও লোকে শকটচক্রে পেষিত হয় না। যে-সব পথ আছে, তাহা তো কুসুমশয্যা বিশেষ। বলি, আপনারা কখনো কখনো অনাবৃষ্টিজনিত ক্লেশ ভোগ করেন কি?’