‘এখন কিন্তু বিপরীত অবস্থা!’ এই বলিয়া আমি হাসিলাম।
‘কিন্তু স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান সেই প্রকারই আছে! কতদিন তাহারা বাহিরে, আমরা ঘরে ছিলাম; এখন তাঁহারা ঘরে, আমরা বাহিরে আছি! পরিবর্তন প্রকৃতিরই নিয়ম! কয়েব বৎসরের মধ্যে আমাদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হইল; তথায় বালকদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
‘আমাদের পৃষ্ঠপোষিকা স্বয়ং মহারানি–আর কি কোনো অভাব থাকিতে পারে? অবলাগণ অত্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে বিজ্ঞান আলোচনা আরম্ভ করিলেন। এই সময় রাজধানীর ___ বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা প্রিন্সিপ্যাল একটি অভিনব বেলুন নির্মাণ করিলেন, এই বেলুনে কতকগুলি নল সংযোগ করা হইল। বেলুনটি শূন্যে মেঘের উপর স্থাপন করা গেল–বায়ুর আর্দ্রতা ঐ বেলুনে সংগ্রহ করিবে উপায় ছিল–এইরূপে জলধরকে ফাঁকি দিয়া তাঁহার বৃষ্টিজল করায়ত্ত করিলেন। বিদ্যালয়ের লোকেরা সর্বদা ওই বেলুনের সাহায্যে জলগ্রহণ করিত কি না, তাই আর মেঘমালায় আকাশ আচ্ছন্ন হইতে পারিত না। এই অদ্ভুত উপায়ে বুদ্ধিমতী লেডি প্রিন্সিপ্যাল প্রাকৃতিক ঝড়বৃষ্টি নিবারণ করিলেন।’
‘বটে? তাই আপনাদের এখানে পথে কর্দম দেখিলাম না।’ কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না–নলের ভিতর বায়ুর আর্দ্রতা কিরূপে আবদ্ধ থাকতে পারে; আর ঐরূপে বায়ু হইতে জল সংগ্রহ করাই বা কিরূপে সম্ভব। তিনি আমাকে ইহা বুঝাইতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আমার যে বুদ্ধি–তাহাতে আবার বিজ্ঞান রসায়নের সঙ্গে আমাদের (অর্থাৎ মোসলেম ললনাদের) কোনো পুরুষে পরিচয় নাই। সুতরাং ভগিনী সারার ব্যাখ্যা কোনোমতেই আমার বোধগম্য হইল না। যাহা হউক তিনি বলিয়া যাইতে লাগিলেন।
‘দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই জলধর বেলুন দর্শনে অতীব বিস্মিত হইল–অতিহিংসায় (২) তাহারা উচ্চাকাঙ্খা সহস্রগুণ বর্ধিত হইল। প্রিন্সিপ্যাল মনস্থ করিলেন যে, এমন কিছু অসাধারণ বস্তু চাই, যাহাতে কাদম্বিনী বিজয়ী বিদ্যালয়কে পরাভূত করা যায়। কেবল ইহাই নহে, তাঁহার প্রচুর পরিমাণে ঐ উত্তাপ সংগ্রহ করিয়া রাখিতে এবং ইচ্ছামত যথাতথা বিতরণ করিতে পারেন।
‘যৎকালে এদেশের রমণীবৃন্দ নানাবিধ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে নিযুক্ত ছিলেন, পুরুষেরা তখন সৈনিক বিভাগের বলবৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলেন। যখন নরনারীগণ শুনিতে পাইলেন যে, জেনানা বিশ্ববিদ্যালয়দ্বয় বায়ু হইতে জল গ্রহণ করিতে এবং সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করিতে পারে, তাহারা তাচ্ছিল্যের ভাবে হাসিলেন। এমনকি তাঁহারা বিদ্যালয়ের সমুদয় কার্যপ্রণালীকে ‘স্বপ্নকল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিতেও বিরত হন নাই।’
আমি বলিলাম, ‘আপনাদের কার্যকলাপ বাস্তবিক অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু এখন বলুন দেখি, আপনারা পুরুষদের কী প্রকারে অন্তঃপুরে বন্দি করিলেন? কোনোরূপ ফাঁদ পাতিয়াছিলেন নাকি?’
‘না এদেশের পুরুষদের বাহুবলে পরাস্ত করা হয় নাই।’
‘হাঁ ইহা অসম্ভব বটে, কারণ পুরুষের বাহু নারীর বাহু অপেক্ষা দুর্বল নহে, তবে?’
‘মস্তিষ্ক-বলে।’
‘তাহাদের মস্তিষ্কও তো রমণীয় তুলনায় বৃহত্তর ও গুরুতর। না–কী বলেন?’
‘মস্তিষ্ক গুরুতর হইলেই কী? হস্তীর মস্তিষ্কও তো মানবের তুলনায় বৃহৎ এবং ভারী, তবু তো মানুষ হস্তীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছে।’
‘ঠিক তো। কিন্তু কী প্রকারে কর্তারা বন্দি হইলেন, এ-কথা জানিবার জন্য আমি বড় উৎসুক হইয়াছি। শীঘ্র বলুন, আর বিলম্ব সহে না।’
‘স্ত্রীলোকের মস্তিষ্ক পুরুষের অপেক্ষা ক্ষিপ্রকারী, এ-কথা অনেকেই স্বীকার করেন। পুরুষ কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে অনেক ভাবে–অনেক যুক্তিতর্কের সাহায্যে বিষয়টি বোধগম্য করে। কিন্তু রমণী বিনাচিন্তায় হঠাৎ সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যাহা হউক, দশ বৎসর পূর্বে যখন সৈনিক বিভাগের কর্মচারীগণ আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদিকে ‘স্বপ্নকল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিয়াছিলেন, তখন কতিপয় ছাত্রী তদুত্তরে কিছু বলিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্ত উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেড প্রিন্সিপ্যালদ্বয় বাধা দিলেন। তাঁহারা বলিলেন যে, তোমরা বাক্যে উতর না দিয়া সুযোগ পাইলে কার্য দ্বারা উত্তর দিও। ঈশ্বর কৃপায় এই উত্তর দিবার সুযোগের জন্য ছাত্রীদিগকে অধিক দিন অপেক্ষা করিতে হয় নাই।’
‘ভারি আশ্চর্য!’ আমি অতিআনন্দে আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া করতালি দিয়া বলিলাম, ‘এখন দাম্ভিক ভদ্রলোকেরা অন্তঃপুরে বসিয়া ‘স্বপ্নকল্পনায়’ বিভোর রহিয়াছেন।’
সারা বলিয়া যাইতে লাগিলেন–
‘কিছুদিন পরে কয়েকজন বিদেশী লোক এদেশে আসিয়া আশ্রয় লইল। তাহারা কোনোপ্রকার রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত ছিল। তাহাদের রাজা ন্যায়সঙ্গত সুশাসন বা সুবিচারের পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি কেবল স্বামিত্ব ও অপ্রতিহত বিক্রম প্রকাশে তৎপর ছিলেন। তিনি আমাদের সহৃদয়া মহারানিকে ঐ আসামি ধরিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু মহারানি তো দয়াপ্রতিমা জননীর জাতি–সুতরাং তাঁহার আশ্রিত হতভাগ্যদিগকে ক্রুদ্ধ রাজার শোণিত-পিপাসা নিবৃত্তের জন্য ধরিয়া দিলেন না। প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা ইহাতে ক্রোধান্ধ হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন।
‘আমাদের রনসজ্জাও প্রস্তুত ছিল, সৈন্য সেনানীগণও নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁহারা বিরোচিত উৎসাহে শত্রুর সম্মুখীন হইলেন। তুমুল সংগ্রাম বাঁধিল, রক্তগঙ্গায় যেন ডুবিয়া গেল! প্রতিদিন যোদ্ধাগণ অম্লানবদনে পতঙ্গপ্রায় সমরানলে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগিল।