‘ভারতবাসী ইচ্ছা করিলে কলিকাতাকে ইহা অপেক্ষা অধিক সুন্দর পুষ্পোদ্যানে পরিণত করিতে পারেন।’
‘তাঁহাদিগকে অনেক গুরুতর কার্য করিতে হয়, তাঁহারা কেবল পুষ্পবনের উন্নতিকল্পে অধিক সময় ব্যয় করা অনাবশ্যক মনে করিবেন।’
‘ইহা ছাড়া তাঁহারা আর কী বলিতে পারেন? জানেন তো অলসেরা অতিশয় বাক্পটু হয়!’
আমার বড় আশ্চর্যবোধ হইতেছিল যে, দেশের পুরুষেরা কোথায় থাকে? রাজপথে শতাধিক ললনা দেখিলাম, কিন্তু পুরুষ বলিতে একটি বালক পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইল না। শেষে কৌতূহল গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পুরুষেরা কোথায়?’
উত্তর পাইলাম, ‘যেখানে তাহাদের থাকা উচিত সেইখানে, অর্থাৎ তাহাদের উপযুক্ত স্থানে।’
ভাবিলাম, তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থান’ আবার কোথায়–আকাশে না পাতালে? পুনরায় বলিলাম, ‘মাফ করিবেন, আপনার কথা ভালোমতো বুঝিতে পারিলাম না। তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থানের’ অর্থ কী?’
‘ওহো! আমার কী ভ্রম!–আপনি আমাদের নিয়মআচার জ্ঞাত নহেন, এ-কথা আমার মনেই ছিল না। এদেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।’
‘কী! যেমন আমরা অন্তঃপুরে থাকি, সেইরূপ তাঁহারাও থাকেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তদ্রূপই।’
‘বাহ্! কী আশ্চর্য ব্যাপার!’ বলিয়া আমি উচ্চহাস্য করিলাম। ভগিনী সারাও হাসিলেন। আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম;–পৃথিবীতে অন্তত এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকে! ইহা ভাবিয়া অনেকটা সান্ত্বনা অনুভব করা গেল!
তিনি বলিলেন, ‘ইহা কেমন অন্যায়, যে নিরীহ রমণী অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে, আর পুরুষেরা মুক্ত, স্বাধীনতা ভোগ করে। কী বলেন, সুলতানা, আপনি ইহা অন্যায় মনে করেন না?’
আমি আজন্ম অন্তঃপুরবাসিনী, আমি এ-প্রথাকে অন্যায় মনে করিব কিরূপে? প্রকাশ্যে বলিলাম–‘অন্যায় কিসের? রমণী স্বভাবত দুর্বলা, তাহাদের পক্ষে অন্তঃপুরের বাহিরে থাকা নিরাপদ নহে।’
‘হ্যাঁ, নিরাপদ নহে ততদিন–যতদিন পুরুষজাতি বাহিরে থাকে। তা কোনো বন্য জন্তু কোনো একটা গ্রামে আসিয়া পড়িলেও তো সে গ্রামখানি নিরাপদ থাকে না। কি বলেন?’
‘তাহা ঠিক; হিংস্র জন্তুটা ধরা না-পড়া পর্যন্ত গ্রামটি নিরাপদ হইতে পারে না।’
‘মনে করুন, কতকগুলি পাগল যদি বাতুলাশ্রম হইতে বাহির হইয়া পড়ে, আর তাহার অশ্ব, গবাদি–এমনকি ভালো মানুষের প্রতিও নানাপ্রকার উপদ্রব উৎপীড়ন আরম্ভ করে, তবে ভারতবর্ষের লোকে কী করিবে?’
‘তবে তাহারা পাগলগুলিকে ধরিয়া পুনরায় বাতুলাগারে আবদ্ধ করিতে প্রয়াস পাইবে।’
‘বেশ! বুদ্ধিমান লোককে বাতুলালয়ে আবদ্ধ রাখিয়া দেশের সমস্ত পাগলকে মুক্তি দেওয়াটা বোধহয় আপনি ন্যায়সঙ্গত মনে করেন, না?’
‘অবশ্যই না! শান্তশিষ্ট লোককে বন্দি করিয়া পাগলকে মুক্তি দিবে কে?’
‘কিন্তু কার্যত আপনাদের দেশে আমরা ইহাই দেখিতে পাই! পুরুষেরা ____ করে, নানা প্রকার দুষ্টামি করে, বা অন্তত করিতে সক্ষম, তাহারা দিব্য স্বাধীনতা ভোগ করে, আর নিরীহ কোমলাঙ্গী অবলারা বন্দিনী থাকে। আপনারা কিরূপে তাহাদিগকে মুক্তি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন?’
‘জানেন, ভগিনী সারা! সামাজিক বিধিব্যবস্থার উপর আমাদের কোনো হাত নাই। ভারতে পুরুষজাতি প্রভু–তাহারা সমুদয় সুখসুবিধা ও প্রভূত্ব আপনাদের জন্য হস্তগত করিয়া ফেলিয়াছে, আর সরলা অবলাকে অন্তঃপুর রূপ পিঞ্জরে রাখিয়াছে! উড়িতে শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া দেওয়া হয়–তদ্ব্যতীত সামাজিক রীতিনীতির কতশত কঠিন শৃঙ্খল পদে পদে জড়াইয়া আছে।’
‘তাই তো! আমার বলিতে ইচ্ছা হয়–‘দোষ কার, বন্দী হয় কে!’ কিন্তু বলি, আপনারা ওসব নিগড় পরেন কেন?’
‘না পরিয়া করি কী? জোর যার মুলুক তার’; যাহার বল বেশি, সেই স্বামিত্ব করিবে–ইহা অনিবার্য।’
‘কেবল শারীরিক বল বেশি হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলেবিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশবী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? আপনাদের কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের উপর কর্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই-ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত–আপনাদের সাহায্য অভাবে সমাজ অর্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।’
‘শুনুন ভগিনী সারা! যদি আমরাই সংসারের সমুদয় কার্য করি, তবে পুরুষেরা কী করিবে?’
‘তাহারা কিছুই করিবে না–তাহারা কোনো ভালো কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দি করিয়া রাখুন।’
‘কিন্তু ক্ষমতাশালী নরবরদিগকে চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে বন্দি করা কি সম্ভব, না সহজ ব্যাপার? আর তাহা যদিই সাধিত হয়, তবে দেশের যাবতীয় কার্য যথা রাজকার্য, বাণিজ্য ইত্যাদি সকল কাজই অন্তঃপুরে আশ্রয় গ্রহণ করিবে যে!’
এবার ভগিনী সারা কিছু উত্তর দিলেন না, সম্ভবত আমার ন্যায় অজ্ঞান তমসাচ্ছন্ন অবলার সহিত তর্ক করা তিনি অনাবশ্যক মনে করিলেন।
ক্রমে আমার ভগিনী সারা গৃহতোরণে উপনীত হইলাম। দেখিলাম, বাড়িখানি একটি বৃহৎ হৃদয়াকৃতি উদ্যানের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এ ভাবটি কী চমৎকার!–ধরিত্রী জননীর হৃদয়ে মানবের বাসভবন। বাড়ি বলিতে একটি টিনের বাঙ্গালা মাত্র; কিন্তু সৌন্দর্যে ও নৈপূন্যে ইহার নিকট আমাদের দেশের বড় বড় রাজপ্রসাদ পরাজিত। সাজসজ্জা কেমন নয়নাভিরাম ছিল; তাহা ভাষায় বর্ণনীয় নহে–তাহা কেবল দেখিবার জিনিস।