একদা আমার শয়নকক্ষে আরামকেদারায় বসিয়া ভারত-ললনার জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলাম–আমাদের দ্বারা কি দেশের কোনো ভালো কাজ হইতে পারে না?–এইসব ভাবিতেছিলাম। সে-সময় মেঘমুক্ত আকাশে শারদীয় পূর্ণিমার শশধর পূর্ণগৌরবে শোভমান ছিল; কোটি লক্ষ তারকা শশীকে বেষ্টন করিয়া হীরক-প্রভায় দেদীপ্যমান ছিল। মুক্ত বাতায়ন হইতে কৌমুদীস্নাত উদ্যানটি স্পষ্টই আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। এক-একবার মৃদুস্নিগ্ধ সমীরণ শেফালি-সৌরভ বহিয়া আনিয়া ঘরখানি আমোদিত করিয়া দিতেছিল। দেখিলাম, সুধাকরের পূর্ণকান্তি, সুমিষ্ট কুসুমের সুমিষ্ট সৌরভ, সমীরণের সুমন্দ হিল্লোল, রজতচন্দ্রিকা, ইহারা সকলে মিলিয়া আমার সাধের উদ্যানে এক অনির্বচণীয় স্বপ্নরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছে। তদ্দর্শনে আমি আনন্দে আত্মহারা হইলাম, যেন জাগিয়াই স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম! ঠিক বলিতে পারি না আমি তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলাম কি না–কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, আমার বিশ্বাস আমি জাগ্রত ছিলাম।
সহসা আমার পার্শ্বে একটি ইউরোপীয় রমণীকে দণ্ডায়মানা দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। তিনি কী প্রকারে আসিলেন, বুঝিতে পারিলাম না। তাঁহাকে আমার পরিচিতা ‘ভগিনী সারা’ (Sister Sara) বলিয়া বোধ হইল। ভগিনী সারা ‘সুপ্রভাত’ বলিয়া আমাকে অভিবাদন করিলেন! আমি মনে মনে হাসিলাম–এমন শুভ্র জোছনাপ্লাবিত রজনীতে তিনি বলিলেন, ‘সুপ্রভাত।’ তাঁহার দৃষ্টিশক্তি কেমন? যাহা হউক, প্রকাশ্যে আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম–
‘আপনি কেমন আছেন?’
‘আমি ভালো আছি, ধন্যবাদ। আপনি একবার আমাদের বাগানে বেড়াইতে আসিবেন কি?’
আমি মুক্তবাতায়ণ হইতে আবার পূর্ণিমাচন্দ্রের প্রতি চাহিলাম–ভাবিলাম, এ সময় যাইতে আপত্তি কী? চাকরেরা এখন গভীর নিদ্রামগ্ন; এই অবসরে ভগিনী সারার সমভিব্যাহারে বেড়াইয়া বেশ একটু আনন্দ উপভোগ করা যাইবে। দার্লিলিং অবস্থানকালে আমি সর্বদাই ভগিনী সারার সহিত ভ্রমণ করিতাম। কত দিন উদ্ভিদকাননে (বোটানিকাল গার্ডেনে) বেড়াইতে বেড়াইতে উভয়ে লতাপাতা সম্বন্ধে–ফুলের লিঙ্গ নির্ণয় সম্বন্ধে কত তর্কবিতর্ক করিয়াছি, সে-সব কথা মনে পড়িল। ভগিনী সারা সম্ভবত আমাকে তদ্রূপ কোনো উদ্যানে লইয়া যাইবার নিমিত্তে আসিয়াছেন; আমি বিনাবাক্যব্যয়ে তাঁহার সহিত বাহির হইলাম।
ভ্রমণকালে দেখি কী–এ তো সে জোছনাময়ী রজনী নহে!–এ যে দিব্য প্রভাত! নগরের লোকেরা জাগিয়া উঠিয়াছে, রাজপথে লোকে লোকারণ্য! কী বিপদ! আমি দিনের বেলায় এভাবে পথে বেড়াইতেছি! ইহা ভাবিয়া লজ্জায় জড়সড় হইলাম–যদিও পথে একজনও পুরুষ দেখিতে পাই নাই।
পথিকা স্ত্রীলোকেরা আমার দিকে চাহিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছিল। তাহাদের ভাষা না বুঝিলেও ইহা স্পষ্ট বুঝিলাম যে, তাহাদের উপহাসের লক্ষ আমিই। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম–
‘উহারা কি বলিতেছে?’ উত্তর পাইলাম,–“উহারা বলে যে, আপনি অনেকটা পুরুষ ভাবাপন্ন।
‘পুরুষভাবাপন্ন। ইহার মানে কি?’
‘ইহার অর্থ এই যে, আপনাকে পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায়।’
‘পুরুষের মত লজ্জানম্র!’ এমন ঠাট্টা! এরূপ উপহাস ত কখন শুনি নাই। ক্রমে বুঝিতে পারিলাম, আমার সঙ্গিনী সে দার্জিলিংবাসিনী ভগিনী সারা নহেন–ইঁহাকে কখনও দেখি নাই! ওহো! আমি কেমন বোকা–একজন অপরিচিতার সহিত হঠাৎ চলিয়া আসিলাম। কেমন একটু বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত হইলাম। আমার সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চিত ও ইষৎ কম্পিত হইল। তাঁহার হাত ধরিয়া চলিতেছিলাম কিনা, তিনি আমার হস্তকম্পন অনুভব করিয়া সস্নেহে বলিলেন–
‘আপনার কি হইয়াছে? আপনি কাঁপিতেছেন যে!’
এরূপে ধরা পড়ায় আমি লজ্জিত হইলাম। ইতস্তত করিয়া বলিলাম, ‘আমার কেমন একটু সংকোচ বোধ হইতেছে; আমরা পর্দানশীন স্ত্রীলোক, আমাদের বিনা অবগুন্ঠনে বাহির হইবার অভ্যাস নাই।’
‘আপনার ভয় নাই–এখানে আপনি কোন পুরুষের সম্মুখে পড়িবেন না। এ দেশের নাম ‘নারীস্থান’ (১) এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।’
ক্রমে নগরের দৃশ্যাবলী দেখিয়া আমি অন্যমনষ্ক হইলাম। বাস্তবিক পথের উভয় পাশ্বস্থিত দৃশ্য অতিশয় রমনীয় ছিল।
সুনীল অম্বর দর্শনে মনে হইল যেন ইতিপূর্বে আর কখন ও এত পরিষ্কার আকাশ দেখি নাই। একটি তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তর দেখিয়া ভ্রম হইল, যেন হরিৎ মখমলের গালিচা পাতা রহিয়াছে। ভ্রমনকালে আমার বোধ হইতেছিল, যেন কোমল মসনদের উপর বেড়াইতেছি,-ভূমির দিকে দৃকপাত করিয়া দেখি, পথটি শৈবাল ও বিবিধ পুষ্পে আবৃত! আমি তখন সানন্দে বলিয়া উঠিলাম, ‘আহা! কি সুন্দর!
ভগিনী সারা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি এ সব পছন্দ করেন কি?’ (আমি তাঁহাকে ‘ভগিনী সারা’ই বলিতে থাকিলাম এবং তিনিও আমার নাম ধরিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন।)
‘হ্যাঁ এসব দেখিয়ে বড়ই চমৎকার। কিন্তু আমি এ সুকুমার কুসুমস্তবক পদদলিত করিতে চাই না।’
‘সেজন্য ভাবিবেন না, প্রিয় সুলতানা! আপনার পদস্পর্শে এ-ফুলের কোন ক্ষতি হইবে না। এগুলি বিশেষ এক জাতীয় ফুল ইহা রাজপথেই রোপন করা হয়।’
দুই ধারে পুষ্পচূড়াধারী পাদপশ্রেণী সহাস্যে শাখা দোলাইয়া দোলইয়া যেন আমার অভ্যর্থনা করিতেছিলাম। দূরাগত কেতকী-সৌরভে দিক পরিপূরিত ছিল। সে সৌন্দর্য ভাষায় ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য–আমি মুগ্ধ নয়নে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে বলিলাম, ‘সমস্ত নগরখানি একটি কুঞ্জভবনের মত দেখায়! যেন ইহা প্রকৃতিরানীর লীলাকানন! আপনাদের উদ্যান-রচনা-নৈপুণ্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।’