ওদিকে মুসলমানেরা দেশসংক্রান্ত কৰ্ত্তব্যসাধনে মগ্ন ছিলেন, এদিকে হজরত আলীর শিষ্যবৰ্গ শিক্ষা বিস্তার করিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁহারা যেখানেই যাইতেন শিক্ষার মশাল সঙ্গে লইয়া যাইতেন, তাহার ফলে এই হইল যে খৃষ্টীয় চতুৰ্দশ শতাব্দী পৰ্যন্ত ইসলামের শিশুদের হন্তেও শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রদীপ দেওয়া হইয়াছিল। যেখানে তাঁহারা দেশ জয় করিতেন, সেইখানেই পাঠশালা ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। ইহার প্রমাণস্বরূপ কাহেরা, বাগদাদ, হিসপ্যানিয়া এবং কার্ডাভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রদর্শন করিতেছি।(9)
ইংলণ্ডের লোকদিগকে মুসলমানরাই তাহাদের বিস্মৃত বিদ্যার বর্ণমালার পুস্তকাবলী অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন। তাঁহারা জ্যোতিষ শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছেন, ভারতবর্ষের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক পুস্তকের অনুবাদ করাইয়াছেন; রসায়ন এবং অঙ্কশাস্ত্রের পুস্তকাবলী রচনা করিয়াছেন।
জনৈক পোপ (দ্বিতীয় মিস্লউটিয়ার) যিনি খ্ৰীষ্টীয় ধৰ্ম্মের অতি উৎকৃষ্ট পণ্ডিত ও গুরু ছিলেন, তিনি মুসলমানদেরই কার্ডাভা মাদ্রাসায় অঙ্কশাস্ত্র শিক্ষা করিয়াছিলেন। এই কারণে লোকে তাঁহাকে বিধর্ম্মী বলিয়া জনসমাজে অপদস্থ করিয়াছিল এবং তাঁহাকে “শয়তানের বাচ্চা” বলিয়াছিল। ইহাতে স্পষ্টই জানা যায় সে সময় ইউরোপের খ্ৰীষ্টীয় বিভাগ কেমন ঘোর মুখতায় তমসাচ্ছন্ন ছিল, আর কেবল ইসলামের অনুবৰ্ত্তিগণই তাহাদিগকে (ইউরোপীয়দিগকে) জ্ঞানের আলোকরশ্মি দেখাইতেছিলেন।
মুসলমানেরা শিল্প এবং আবিষ্কারেও পশ্চাৎপদ ছিলেন না। অনুবীক্ষণ যন্ত্র তাহারাই নিম্পর্মাণ করেন; পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের পরিমাণ র্তাহারাই স্থির করেন। গ্ৰীকদের নিকট হইতে র্তাহারা অঙ্কবিদ্যালাভ করেন; সঙ্গীত ও কৃষিবিদ্যাকে তাহারা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত করিয়াছিলেন। তাহারা এই পৰ্য্যন্ত করিয়াই নিশ্চিন্তু ছিলেন না, বরং ধর্ম্মের দর্শন তত্ত্বের অতি সূক্ষ্ম আলোচনা করিয়া “ফানাফিল্লাহ’র গুঢ় তত্ত্বে উপনীত হইয়াছেন। তাঁহারা প্রচার করিলেন যে আল্লাহ অদ্বিতীয় এবং সমুদয় মানবজাতি এক জাতীয় (মানবের মধ্যে জাতিভেদ নাই)। আর এই বিধান তাহারা অতি মনোরম ভাষায় বুঝাইয়াছেন।
হে হিন্দু ভ্রাতৃগণ! আপনারা যদি ঐ শাস্ত্রবিধানসমূহের বিষয় চিন্তা করেন ত আপনারা উহাকে প্রকৃত (আসল) বেদান্ত স্বরূপ পাইবেন; মুসলমানদের মধ্যে পূর্ণ ছয় শত বৎসর পৰ্যন্ত শিক্ষা উন্নতির দিকে অগ্রসর হইয়াছিল। অদ্য যদি আমার মুসলমান ভ্রাতৃগণ নিজেদের ঐ সকল জগন্মান্য পূৰ্ব্বপুরুষদের রচিত শিক্ষা সংক্রান্ত পুস্তকাবলী আধুনিক প্রচলিত ভাষায় অনুবাদ করিয়া লয়েন এবং সৰ্ব্বসাধারণে ঐ শিক্ষা প্রচার করেন তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাহারা ইসলামী দর্শনকে সমস্ত জগতের শীর্ষস্থানে তুলিতে সক্ষম হইবেন। আর ইসলামের আবালবৃদ্ধবনিতা— (কচি কচি শিশুগণ)ও ইসলামী দর্শন কণ্ঠস্থ করিতে পরিবে। (যেমন হিন্দুগণ এখন আপন বেদান্ত প্রচারে মনোযোগী হইয়াছেন)। আপনারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন যে তাহারা ইসলামের প্রকৃত গৌরব সৃষ্টি জগৎকে দেখাইবার জন্য কিরূপে ধর্ম্মের সেবা করিয়াছেন।
হজরত মোহাম্মদ, হজরত ঈসা, রাজদশত, মুসা, মহর্ষি বুদ্ধদেব—সকলে একই অট্টালিকায় আছেন। তাহারা এক জাতি হইতে অন্য জাতিকে ভিন্ন মনে করেন না। আর আমরা যে তাঁহাদের সামান্য শিষ্য, তাহাদের শিশু সন্তান-আমাদের উচিত যে তাঁহাদের বিশ্বপ্রেমের সারাতত্ত্ব লাভ করি। প্রেম দ্বারাই তাহারা আমাদের নিকটবৰ্ত্তী হন। পয়গম্বর মোহাম্মদ সাহেব’ স্বেচ্ছায় স্বীয় শিষ্যের নিকটবৰ্ত্তী হন না, যে পৰ্য্যন্ত শিষ্য মনের কঠোরতা দূর না করে এবং তাহার হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার না হয়।
হে আমার মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ! পয়গম্বর সাহেব যেমন আপনাদের সেইরূপ আমাদেরও আপন। যত পয়গম্বর মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্ত জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সকলের উপরই আমাদের দাবী (হক) আছে। আমরা তাহাদিগকে ভালবাসি, তাহদের সম্পমান করি এবং তাঁহাদের সম্পমূখে অতি নম্নভাবে ভক্তি সহকারে মস্তক অবনত করি।
খোদার নিকট এই প্র্যর্থনা করি যে তিনি সকলেরই আল্লাহ;- তিনি আমাদিগকে এইরূপ বুঝিবার শক্তি দান করুন যে তাহার নামের জন্য যেন আমরা পরস্পরে ঝগড়া না করি।–আমাদের শিশুসুলভ দূৰ্ব্বল অধরে যে নামই উচ্চারিত হউক না কেন-কিন্তু তিনিই ত অদ্বিতীয় এবং সকলেরই উদ্দেশ্য (উপাস্য) একমাত্র তিনিই।(10)
——————
1. আশ্চর্য্যের বিষয়, এই সভ্যযুগেও বঙ্গীয় মুসলমানদের ঘরে ঐরূপ বংশানুক্রমে চিরস্থায়ী বিবাদ দেখা যায়। এইজন্য আমরা কলিকাতা হাইকোর্টে “Hereditary enemy” শব্দ শুনিতে পাই। আহা! কবে আমাদের প্রতি খোদাতালার রহমৎ হইবে!
2. হিজরতের পিতামহ আবদুল মুত্তালিব যে স্বীয় পুত্র হজরত আবদুল্লাকে প্রস্তরমূৰ্ত্তির নিকট বলিদান করিতে গিয়েছিলেন, এ কথার সত্যতায় আমার একটু দ্বিধা বোধ হয়। আলেম ফাজেলগণ দয়া করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করিলে বিশেষ বধিত হইব। বাঙ্গালা “আমির হামজা” পুঁথিতে দেখিয়ছি, – (হজরত আবদুল মুত্তালিবের অন্য পুত্র হজরত আমির হামজা পিতাকে বলিলেন)-
“কাফেরে খাজনা দিবে মোছলমান হৈয়া।
আমি এয়ছা বেটা তবে কিসের লাগিয়া।।”
3. ইহা মিসিস বেশান্তের অতিশয়োক্তি। (আল-এসলাম সম্পাদক)
4. মিসিস এনি বেশন্তের বর্ণিত মুসলমান কি আমরাই? ছিঃ! ছি:! ধিক আমাদের! আমরা মুসলমান নামের কলঙ্ক। বঙ্গদেশে দড়ি ও কলসী একেবারে নাই কি?
5. অল্পদিন হইল-মুসলমান গ্ৰন্থকাবগণ ইংরাজী ভাষায্য এসলাম-সম্বন্ধে পুস্তক পুস্তিকা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, ইহার পূৰ্ব্বে ইউরোপে এসলাম সম্বন্ধীয় সমস্ত জ্ঞাতব্যই খ্ৰীষ্টান মিশনের এজেন্সী হইতে সংগ্ৰহ করা হইত-কাজেই অজ্ঞ ইউরোপ এসলামের নামে একেবারে শিহরিয়া উঠিত। এই অল্পদিনের চেষ্টায় কিরূপ ফল হইয়াছে, এই বক্তৃতা হইতেই তাহার আভাষ পাওয়া যাইতেছে। লর্ড হেড্রলি, খাজা কামালুদ্দিন, মিঃ, এহয়-উন-নাসর পর্কিনসন প্রভৃতি মুসলমান লেখকগণের চেষ্টায় ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের কিরূপ মত পরিবর্তন হইতেছে, “Islamic Review” পত্র পাঠ করিলে তাহা সম্যক অবগত হওয়া যাইতে পারে। আল-এসলাম-সম্পাদক।
6. মিসিস বেশান্ত এখানে দুইটী ঘটনা ভ্রমক্রমে এক বর্ণনার ভিতর ফেলিয়াছেন। অমুসলমানের পক্ষে এইরূপ ভ্ৰম মার্জনীয় (আল এসলাম–সম্পাদক)
7. মিসিস এনি বেশান্তি এ স্থলে “আক্কাসের তাজিয়ানৱ” বিষয় উল্লেখ করেন নাই; আমার মনে হয় এজন্য “প্রতিশোধ” বিষয়টি অঙ্গহীন ও অসম্পূর্ণ রহিয়াছে। সে তাজিয়ানার কথা এই :
কোন এক দিন হজরত কোন কারণে আক্কাস নামে এক ব্যক্তিকে এক ঘা কোড়া মাবিয়াছিলেন। অদ্য সেই আক্কাস মসজিদে আসিয়া সেই কোডার প্রতিশোধ পাইবোব দাবী কবিল, তখন বসূল, তাহার হস্তে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্রস্তুত হইলেন। ইহা দেখিয়া উপস্থিত সহচরবৃন্দ ও আত্মীযবান্ধবগণ অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত ও উদ্বিগ্ন হইলেন; যেহেতু হজরত এমন পীড়িত অবস্থায় কোড়াব আঘাত কিছুতেই সহ্য করিতে পরিবেন না। র্তাহারা অনুনয বিনয় কবিয়া আক্কাসকে নিবৃত্ত হইতে, অথবা রসুলের পবিবৰ্ত্তে তাঁহাদের গাত্রে একাধিক কোড়া মারিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু আক্কাস তাহাদের কোন কথায় কৰ্ণপাত কবিল না। তখন তাহাবা অতিশয় অধীব হইয়া ক্ৰন্দন ও বিলাপ কবিতে লাগিলেন,-নিষ্ঠুর আক্কাস করে কি? হায় হায, বসুল হত্যা করিবে; হজরত কিন্তু অবিচলিত চিত্তে আক্কাসকে তাহার আকাঙ্গিক্ষত প্রতিশোধ লহঁতে ইঙ্গিত কবিলেন। সে বলিল, “হজরত! আমি নগ্ন পণ্ঠে আপনার কোড়ার আঘাত পাইয়াছিলাম।” এতচ্ছবণে রসূলে করিম তৎক্ষণাৎ গাত্রবস্ত্র উন্মোচন করিয়া নগ্নদেহে কশাঘাত গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত হইলেন। বলি, আজ পর্যন্ত জগতে কেহ ঐরূপ ঋণ পবিশোধ করিতে পাবিয়াছে কি? আমার বিশ্বাস বসুলকে গাত্র বস্ত্র মোচন কবিতে দেখিযা স্বর্গদূত (ফেরেশতা) পর্যন্ত কম্পিত হইয়াছিলেন! এরূপ। মাহাত্ম্যু আরও কোন মহাপুরুষ দেখাইতে পারিয়াছেন কি? আক্কাস অবশ্য রসূলকে কোড়া মারিবার অভিপ্ৰায়ে আসিয়াছিল না, তাহার উদ্দেশ্য ছিল হজরতের পবিত্র পৃষ্ঠ চুম্বন করা। সে উদ্দেশ্য সফল হইল-ত্রুদনের রোলের মধ্যে ভক্তির জয় জয়কার ঘোষিত হইল।
–লেখিকা।
8. সুশিক্ষার কল্যাণে শত্রু জয় করা যায় একথা ধ্রুব সত্য। ঐ কারণেই বোধ হয় নারী বিদ্বেষী মহাশয়গণ স্ত্রী শিক্ষায় আপত্তি করেন। যেহেতু তাহা হইলে স্ত্রীলোকের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়! শুনিয়াছি, করটীয়ার প্রসিদ্ধ জমিদার মরহুম জমবরদন্নেসা খানম সাহেবা নাকি বলিয়াছেন, “এখন মরদের হাতে কলম; একবার জানোনার হাতে কলম দিয়া দেখা।” ইংরাজী প্রবচন বলে। “Pen is mightier than sword” –লেখিকা
9. আমাদের সদাশয় বৃটিশ প্ৰভুৱা দাবী করেন যে তাহারা অনুগ্রহপূর্বক ভারতবর্ষ জয় করিযাছেন বলিয়াই আমরা (বৰ্ব্বারবা) শিক্ষার আলোক প্রাপ্ত হইয়াছি। আর আমরাও নত মস্তকে স্বীকার করিয়া বলি যে,-“ইয়ে হয় আহলে মগরেবকে বরকৎ কদমকী” (ইহা পশ্চিম দেশবাসিদিগের শ্ৰীচরণের প্রসাদ)। কিন্তু মিসিস বেশান্ত ত বলেন যে শিক্ষা বিস্তার বিষয়ে মুসলমানেরাই ইউরোপের শিক্ষা গুরু।
10. এই সকল বিষযেব সহিত আমাদের মতানৈক্য নাই। মিসিস এনি বেশান্তি মহোদয়া থিওসোফীী একজন লর প্রতিষ্ঠ প্রচারক ও শিক্ষা গুরু। তিনি নিজের শিক্ষা ও ধর্ম্মের দিক দিয়া এসলামের সমালোচনা করিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার সব কথার সহিত আমাদের মতের মিল থাকিতে পাবে না। এসলামেী প্রকৃত স্বকাপ এখনও বহুস্থলে অপ্রকাশিত বহিয়াছে। আমরা যদি যথাযথভাবে ঐ স্বরূপটা জগতের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারি, তাহা হইলে প্রত্যেক ন্যায়দর্শী ও সত্যানুসন্ধিৎসু হৃদয়ই তাহার নিকট আত্মদান করিতে বাধ্য হইবে। আল্লার খেরিত সমস্ত ধৰ্ম্মপ্রচারক যাহারা মানবজাতির কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে আগমন করিয়াছেন, মুসলমান মাত্রেরই মান্য ও নমস্য। তাহাদিগের উপর বিশ্বাস না কবিলে কেহ মুসলমানই হইতে পারে না। আর আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রে যে সকল পয়গম্বরের নামোল্লেখ হইয়াছে, তাহা বাদে আরও অনেক পয়গম্বর আছেন, যাহাঁদের নাম হজবত মোহাম্মদ (দঃ) কে জ্ঞাত করা হয় নাই। অধিকন্তু প্ৰত্যেক দেশ ও প্রত্যেক জাতির নিকট প্রেরিত পুরুষগণ আসিযাছেন ও স্বর্গের বাণী শুনাইয়াছেন, এই সমস্ত কথার প্ৰত্যেকটিই কোরআন শরীফের স্পষ্ট আয়াৎ দ্বারা প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আমরা মিসিস মহোদয়ার মন্তব্যের পূর্ণ সমৰ্থন কবিতেছি। (আল। এসলাম-সম্পাদক।)
সুলতানার স্বপ্ন
(বর্তমান লেখিকার Sultana’s Dream গত ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে Indian Ladies Magazine-এ প্রকাশিত হইয়াছিল।)