হঠাৎ পশুপতিবাবুর একটা চিঠি পেলাম।
তিনি লিখেছেন–বাড়ি মেরামত করতে গিয়ে পুঁথির আরও অনেকগুলো পাতা পাওয়া গিয়েছে, আপনি একবার এসে দেখে যাবেন—
পুরনো পুঁথি নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তারা জানেন, এর মধ্যে অনেক রকম ভেজাল থাকে। একজন চণ্ডীদাস শেষকালে দশজন চণ্ডীদাসে পরিণত হতে পারে। তখনকার দিনে ছাপাখানা ছিল না। একহাজার পাতার একখানা পুঁথি একজন নকলনবিশকে পাঁচটা টাকা আর একখানা বাঁধিপোতা গামছা দিলেই নকল করে দিত। তারপর তার মধ্যে নিজের বিদ্যে বুদ্ধি শিক্ষা অশিক্ষা ঢুকিয়ে দিলে কারও
আর কিছু ধরার উপায় থাকত না।
কিন্তু এ-পুঁথি অন্যরকম। এ কবি নিজের হাতেই লিখেছেন বলে মনে হল। এমন কিছু বিখ্যাত কবিও নন। নকলনবিশের হাতের ছোঁয়াচ কোথাও পাওয়া গেল না। আর পশুপতিবাবু নিজেই বলছেন তাদের পূর্বপুরুষ উদ্ধব দাস। খাস বিশ্বাস হলেও দাসই বটে। কিন্তু কবি বিনয়ী। বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে উদ্ধব দাসও নিজেকে ভক্ত হরিদাস বলে ঘোষণা করেছেন। দাসানুদাস। তিনি নিজে কিছুই নয়। নিজের জন্যে তিনি কিছুই করেননি। এই জমি, এই সম্পত্তি, এই ভোগ-ঐশ্বর্যবিলাস তার কিছুই তার প্রাপ্য নয়। তিনি এই সংসারে ঈশ্বরের কৃপায় এসেছিলেন আবার একদিন ঈশ্বরের কৃপাতেই বিদায় নেবেন। এ-সংসারে কে কার? এ-সংসারই তো তার লীলাভূমি গো।
আমার খুব আগ্রহ ছিল এই বেগম মেরী বিশ্বাস সম্বন্ধে কিছু জানতে। কে এই মেরী বিশ্বাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসে লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে এই বেগমের কীসের সম্পর্ক। এই হাতিয়াগড়ের রানিবিবিই বা কে? যে কান্ত ছেলেটি নিজামত নবাব-সরকারের হুকুম পেয়ে কোনও হিন্দু রানিবিবিকে নিয়ে কাটোয়ার সরাইখানাতে উঠল, ও-ই বা কে? উদ্ধব দাসই বা এদের কথা জানল কী করে? সে এত বড় মহাকাব্য লিখতে গেল কেন? যে-ইতিহাস ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে পড়ে এসেছি এর সঙ্গে তো তা মিলছে না। উদ্ধব দাস এ ইতিহাস কোথায় পেলে?
পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে এল। তারপর কলকাতার অন্ধকার ঘরের মধ্যে একে একে পৃথিবীর সমস্ত লোক ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু আমি একলা জেগে রইলাম, আর জেগে রইল ইন্ডিয়ার অষ্টাদশ শতাব্দী। অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই পৃথিবী থেকে আর্তকণ্ঠের এক করুণ চিৎকার ভেসে উঠল। সে কান্না সেদিন কেউ শুনতে পায়নি। আলিবর্দির হারেমের মধ্যে সেই একক-কান্না এত বছর পরে আবার যেন পুঁথির পাতা বেয়ে আমার কানে এসে পৌঁছোল। কে কাঁদছে? আজকে চারিদিকে যখন সবাই হাসছে, তখন কাঁদছে কে?
কোথাও তো কেউ জেগে নেই। অষ্টাদশ শতাব্দী, উনবিংশ শতাব্দী, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পেরিয়ে এসেও আমরা তো সবাই ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। যারা পাহারা দেবার ছিলেন তারা সবাই তো বিদায় নিয়েছেন। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ, কেউ নেই পাহারা দেবার। মাঝখানে দু’দুটো বড় যুদ্ধ আমরা পার হয়েছি। দু’শো বছর ব্রিটিশের তবে কাটিয়ে আমাদের মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছে। আমরা নির্বিঘ্নে অনাচার করছি, অত্যাচার করছি, চুরি করছি, ব্ল্যাকমার্কেট করছি, লোক-ঠকানোর কারবারে আমরা বেশ রীতিমতো পাকা হয়ে উঠেছি। ঘটনাচক্রে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা তো স্বাধীন হইনি। দারিদ্র্য আর অভাব আর অনাচার থেকে তো মুক্তি পাইনি। কিন্তু তবু তো আমরা কেউ-ই কঁদিনি। তবে এমন করে আজ কাঁদছে কে?
অথচ আমরাই এতদিন খদ্দর পরেছি, চরকা কেটেছি, লবণ সত্যাগ্রহ করেছি। এতদিন মেদিনীপুরে একটার-পর-একটা বিলিতি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের গুলি করে মেরেছি। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে সাহেবদের খুন করে কঁসি গিয়েছি। পাড়ায় পাড়ায় লাঠিখেলা কুস্তি করার আখড়া বানিয়েছি। বন্দে মাতরম’ শুনলে আমাদের রক্ত নেচে উঠেছে। সেসব কথা তো স্বাধীন হবার পর আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমি আর পশুপতিবাবুরা তো খদ্দর পরা ছেড়েই দিয়েছি। লুকিয়ে লুকিয়ে বিলিতি জিনিস কিনতে পেলে বর্তে গিয়েছি। লাঠিখেলা আর কুস্তির আখড়া তুলে দিয়ে সেখানে আমরা সরস্বতীপুজো করি। পুজোর ঠাকুরের সামনে আমরা লাউডস্পিকার লাগিয়ে সিনেমার সস্তা গান মাইক্রোফোনে বাজাই। আমরা ধুতি ছেড়ে দিয়ে সরু-পা-ওয়ালা প্যান্ট পরি। ট্র্যানজিস্টার-সেট কাঁধে ঝুলিয়ে মডার্ন হয়ে ঘুরে বেড়াই। কাঁদবার তো আমাদের সময় নেই! তবে এমন করে আজ কাঁদছে কে?
হঠাৎ নজরে পড়ল বিরাট দমদম হাউসের এককোণে বেগম মেরী বিশ্বাস একা জেগে জেগে কাঁদছে।
উদ্ধব দাস তাঁর কাব্যের শেষ সর্গে শান্তিপর্বের ভেতর বেগম মেরী বিশ্বাসের যে-চিত্র এঁকেছেন তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষ আজ এই বিংশশতাব্দীর মানুষের মতোই সেদিন নিজেদের বুঝতে পারেনি। একদিন হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে পরোয়ানা পাঠিয়ে নবাবের হারেমের মধ্যে এনে পুরেছে। সে ছিল লালসা আর রূপের আকর্ষণ। মেয়েমানুষের দেহ আর অর্থ উপার্জনের কলাকৌশল আয়ত্ত করাকেই সেদিন চরম মোক্ষ বলে জ্ঞান করেছে সবাই। টাকা চাই। যেমন করে হোক টাকা চাই-ই। জীবন অনিত্য। এই জীবদ্দশাতেই আমার ভোগের চরম পরিতৃপ্তি চাই। বাদশার কাছ থেকে পাওয়া খেতাব চাই। নবাবের পেয়ারের পাত্র হওয়া চাই। তা হলেই বুঝলাম আমার সব চাওয়া-পাওয়া মিটল। তা হলেই বুঝলাম আমার মোক্ষ লাভ হল।