সুতরাং পুব দিকে দৌড়োও। পালাও পালাও।
যার যেদিকে চোখ গেছে সেই দিকেই পালিয়েছে। শেষকালে সেই ঘুরঘুটি অন্ধকারে দৌড়োতে দৌড়োতে একেবারে সোজা গঙ্গা। গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে একেবারে কলকাতায়। কলকাতায় বেভারিজ সাহেবের সোরার গদিবাড়ি গঙ্গার ঘাটের ওপর। সকালবেলা সেখানে গিয়েই দাঁড়িয়েছিল কান্ত। আর তো কেউ নেই তখন তার। আর কলকাতাতে কে থাকবে কার, গোটাকয়েক চালাঘর, কয়েকটা পাকা বাড়ি ফিরিঙ্গিদের কোম্পানি তখন সেই জলাজঙ্গলেই বেশ কায়েম হয়ে উঠেছে।
বেভারিজ সাহেব তখন পালকিতে চড়ে গদিবাড়ি দেখতে এসেছে।
জিজ্ঞেস করলে–হু আর ইউ? টুমি কে?
তখন কান্ত ইংরেজি বুলি জানত না। কিছু ফারসি পড়েছে সারদা পণ্ডিতের মক্তবে, আর কিছু বাংলা বরদা পণ্ডিতের পাঠশালায়। অথচ আশ্চর্য, শেষকালে সেই কান্তই বেশ গড়গড় করে সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজি বুলি আউড়ে যেত। চাকরিতে টিকে থাকলে কান্তর আরও উন্নতি হত হয়তো। বেভারিজ সাহেবের নেকনজরে পড়ে অনেক কিছু করে নিয়েছে। কিন্তু কাল হল বশির।
বশির মিঞা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল–কত তলব পাস তুই এখেনে?
তিন টাকা।
বশির মিঞা নবাব-সরকারের লোক। নিজামতের পেয়ারের নোকর। চুড়িদার পায়জামার ওপর চুনোট করা মলমলের পিরান পরে। কাঁধে আবার কলকার কাজ। বাহারে টেড়ি, পান-জর্দা কিমাম খেয়ে মুখ লাল করা থাকে সবসময়। তলবের অঙ্ক শুনে হো হো করে হেসে উঠল। বললে–দুর। নবাব-নিজামতের খেদমতগার পর্যন্ত রোজ তিন টাকা আয় করে।
কীসে আয় করে?
রিশশোয়াত! ঘুষ! তোর নোকরিতে ঘুষ আছে?
কান্ত বললে–না, শুধু বকশিশ দেয় সাহেব–
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠল বশির, ঘুষ না হলে নোকরি করে ফয়দা কী? আমি তো তিনটে বিবি রেখেছি ওই ঘুষের জোরে। তলব তো পাই দশ টাকা। দশ টাকায় তিনটে বিবি পোষা চলে? তুই-ই বল না? তিন বিবির নোকর-নোকরানি আছে, বিবিদের বায়নাক্কা কি কম নাকি? সরাবের একটা মোটা খরচা আছে, পান-তামাকু কোনটা নেই? দশ টাকায় চলে কী করে?
কান্তও বশিরের বড়লোকিপনার বহর শুনে হতবাক।
জিজ্ঞেস করলে–তুই দশ টাকায় চালাস কী করে?
বশির মিঞা বললে–ঘুষ নিয়ে–
তোকে ঘুষ দেয় কেন লোকে?
ঘুষ না দিলে নবাব কাছারিতে কারও কাজ হোক দিকিনি দেখি!
তুই কি কাছারিতে কাজ করিস?
আরে না, নিজামতের খাস মোহরার আমার ফুপা। আমার ফুপাকে বলে দিলে তোরও নোকরি হয়ে যাবে নিজামতে–! তুই নোকরি নিবি?
কিন্তু বেভারিজ সাহেব যে আমাকে খুব ভালবাসে। গদিবাড়ির চাবি যে আমার হাতে থাকে।
বশির মিঞা কান্তর বোকামি দেখে হাসবে কি কাদবে বুঝে উঠতে পারলে না।
আরে নিজামতের নোকরির কাছে ফিরিঙ্গি সাহেবের নোকরি? ওরা তো বিলাইত থেকে কারবার করতে এসেছে। সোরা কিনবে সুতো কিনবে আর দরিয়ার ওপারে চালান দেবে। ওদের কোম্পানি যখন উঠে যাবে তখন কী করবি? তখন বেভারিজ সায়েব তোকে খিলাবে? তখন তো ফ্যা ফ্যা করে নোকরির চেষ্টায় ঘুরে বেড়াবি মুর্শিদাবাদের দফতরে–ওরা তো আর হিন্দুস্তানে মৌরসিপাট্টা নিয়ে জমিনদারি করতে আসেনি–
কান্ত খবরটা শুনে সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ফিরিঙ্গি কোম্পানি কারবার গুটিয়ে কালাপানি পাড়ি দিয়ে চলে যাবে?
তা যাবে না? ওরা তো পয়সা লুঠতে এসেছে, পয়সা না পেলেই চলে যাবে। পয়সা না পেলে কেউ ঝুটমুট পড়ে থাকে? আবার যেখানে পয়সা কামাবে সেখানে চলে যাবে। ওদের কী? ওরা বেনের জাত, পয়সা কামিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে একদিন চলে যাবে। তখন ভো-ভ-মাঝখান থেকে তোর নোকরিটা খতম হয়ে যাবে
সেই বশির মিঞার কথাতেই বলতে গেলে কান্ত বেভারিজ সাহেবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই নিজামত সরকারের চাকরিতে ঢুকেছে।
বশির মিঞা বলেছিল–মন দিয়ে টিকে থাক তুই, এখন নতুন নবাব হয়েছে, আমার ফুপার বড় ইয়ার মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শা কুলি খান বাহাদুর হেবাত জঙ আলমগির–
তা সেই চাকরিতে ঢুকতে-না-ঢুকতে প্রথম হুকুম হয়েছে হাতিয়াগড় থেকে সেখানকার রানিবিবিকে মুর্শিদাবাদের হারেমে নিয়ে আসতে হবে। এনে কী হবে, কিছুই বলে দেয়নি বশির মিঞা। নিজামতের হুকুম হচ্ছে হুকুম। দুটো সেপাই দিয়েছে কোতোয়ালি থেকে তার সঙ্গে, পালকি দিয়েছে, পালকি-বেহারা দিয়েছে, নিজামতি পাঞ্জা দিয়েছে।
ও কান্তবাবু!
সেপাই দুটো গাছতলা থেকে ডাকছিল কান্তকে। কিন্তু তার আগেই সরাইখানার ভেতর থেকে মিহি গলায় আর একটা ডাক এল।
বাবুজি!
সেই বাঁদিটা। বোরখার মুখের ঢাকনাটা ঈষৎ খুলে তাকে ডাকছে।
কান্ত কাছে গেল। আমাকে ডাকছ নাকি?
বিবিজি গোসলখানায় গিয়েছিল, খানার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলছেন, বাবুজিকে ডেকে আন!
আমাকে? কেন?
তা জানি না হুজুর।
মুসলমানি খানা খাবেন না বুঝি? তা আমি তো সেই জন্যেই কোতোয়ালিতে যাচ্ছি হিঁদু খানার বন্দোবস্ত করতে–
বাঁদি বললে–না, তা নয় হুজুর, বিবিজি মুসলমানি খানা খাবেন আমাকে বলেছেন।
মুসলমানি খানা খাবে? হাতিয়াগড়ের রানিবিবি হিন্দুর মেয়ে হয়ে মুসলমানের ছোঁয়া খাবে? তুমি ঠিক বলছ?
জি হাঁ–আপনি ভেতরে আসুন, বিবিজি আপনার সঙ্গে একবার মোলাকাত করবেন আপনি আসুন
কান্ত একটু আড়ষ্ট হয়ে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে বলল–আচ্ছা। চলো–
*
ঠিক এই পর্যন্ত এসেই পাতাটা শেষ। এর পর আর নেই। অনেক খুঁজে খুঁজেও আর পাওয়া গেল না। পুরনো পুঁথি পড়ার এই একটা অসুবিধে। যেখানে ঠিক কৌতূহলটা ঘন হয়ে আসছে সেই জায়গাটাই বেছে বেছে পোকায় কাটে, সেই জায়গাটাই বেছে বেছে হারিয়ে যায়।