এই যে নলহাটি আজিমগঞ্জ লাইনে সাগরদিঘি নামে একটা ইস্টিশন, ওর পেছনেও একটা গল্প আছে। কিন্তু সে-গল্প থাক। এবার অন্য একটা গল্প বলি। সাগরদিঘি থেকে চার ক্রোশ উত্তর-পুবে একটা গাঁ আছে, তার নাম এক-আনি চাঁদপাড়া। গৌড়ের সিংহাসনে একদিন হোসেন সাহ্ জবরদস্ত নবাব বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেই হোসেন সাহেবের বাবা এই চাঁদপুরে এসে উঠেছিলেন। কিন্তু অবস্থা বৈগুণ্যে চাকরি নেন এক ব্রাহ্মণের কাছে। চৈতন্যচরিতামৃতে ওই ব্রাহ্মণের নাম সুবুদ্ধি রায় বলে লেখা আছে। লোকে সুবুদ্ধি রায়কে চাঁদ রায় বলে ডাকত। চাঁদপাড়ার কাজি হোসেন সাহের গুণের পরিচয় পেয়ে নিজের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। একদিন যে ছিল সুবুদ্ধি রায়ের আশ্রিত, সে-ই আবার একদিন গৌড়ের রাজ-সিংহাসন আলো করে বসল। কিন্তু সুবুদ্ধি রায়ের কথা হোসেন সাহ ভোলেননি। নবাব হয়েই চাঁদপাড়া গ্রামটার স্বত্ব সুবুদ্ধি রায়কে এক আনা খাজনায় দিয়ে দিলেন। তখন থেকেই সেই গ্রামের নাম হয়ে গেল এক আনি চাঁদপাড়া।
কিন্তু আজ যে রাজা আবার কালই হয়তো সে ফকির হয়ে যাবে। একদিন সুবুদ্ধি রায়ের ক্ষমতা এমনই বেড়ে উঠল যে, তখন হোসেন সাহই বা কে জগদীশ্বরই বা কে! সেই সুবুদ্ধি রায়ই একদিন চাবুক মেরে হোসেন সাহের গায়ে দাগ বসিয়ে দিলেন। আর যায় কোথায়! হোসেন সাহ কিছু বললেন না, কিন্তু তার বেগম বড় চটে গেলেন।
স্বামীকে বললেন–এত বেয়াদপি কাফেরের?
হোসেন সাহ বললেন–তা হোক, একদিন তো রায়মশাইয়ের খেয়ে-পরেই মানুষ হয়েছি–
ওসব যুক্তিতে ভুললেন না বেগম সাহেবা। তিনি বললেন–সুবুদ্ধি রায় যা-ই হোক, ও হল কাফের, কাফেরকে খুন করলে কোনও গুণাহ হয় না–
শেষে বেগমের কথাও রইল, সুবুদ্ধি রায়ের সম্মানও রইল। হোসেন সাহ একদিন আচমন করতে করতে সুবুদ্ধি রায়ের গায়ে জল ছিটিয়ে দিলেন। সেই জল তার মুখে গিয়ে লাগল। এরপর সুবুদ্ধি রায় আর সংসারে থাকেননি। সংসার ত্যাগ করে মহাপ্রভুর নামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
এ তো গেল পাঠান আমলের কথা। সেই হোসেন সাহই বা কোথায় তলিয়ে গেল। তার জায়গায় শেষ নবাব এল দায়ূদ খাঁ। পাঠান আমলের ইতি হল এই দায়ূদ খাঁর আমলেই। মানসিংহ এসে হাজির বাংলার সুবেদার হয়ে। মোগল-পাঠানে লড়াই হল এই গঙ্গার ধারেই সেরপুর আতাই-এ! এই সেরপুর আতাইতেই পাঠানদের হাতির দল পালিয়ে বাঁচল। সেই মানসিংহের সঙ্গেই একজন ব্রাহ্মণ বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি কান্যকুজের লোক, জিঝোতিয়া বংশের ব্রাহ্মণ। মানসিংহের সৈন্য তিনিই পরিচালনা করতেন। তাঁর নাম সবিতা রায়। এই সবিতা রায়ই বর্তমান জেমো রাজবংশের আদিপুরুষ। এই বংশের জয়রাম রায় কপিলেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে-মন্দিরও এই গঙ্গার গর্ভেই চলে গেছে।
এ-গঙ্গা নিয়েছেও যেমন অনেক আবার দিয়েছেও অনেক। এই গঙ্গাই ঘসেটি বেগমকে নিয়েছে, আমিনা বেগমকে নিয়েছে। নানিবেগম, ময়মানা বেগমকে নিয়েছে। লুৎফুন্নিসা বেগমকেও নিয়েছে। আর দিয়েছে এই মরালীকে। এই মরিয়ম বেগমকে। এই বেগম মেরী বিশ্বাসকে। এই যে-বেগম মেরী বিশ্বাসের গল্প এখানে আপনাদের বলতে বসেছি।
তা এই গঙ্গার পাড় ধরেই হাতিয়াগড়ের রানিবিবির পালকিটা এসে থামল কাটোয়ার সরাইখানার সামনে। কোতোয়ালের হেফাজতে ছিল এ-বাড়িটা। নবাব আলিবর্দি খাঁ একবার বর্গিদের তাড়িয়ে দিয়ে এসে নানিবেগমকে নিয়ে এক রাত্রের জন্যে এখানে উঠেছিলেন। সবরকম বন্দোবস্তই আছে এখানে। দরকার হলে এখানকার খিদমদগার গরম জলের ব্যবস্থা করতে পারে স্নানের জন্যে। খাবার বলল খাবার, বিছানা বলো বিছানা, এমনকী তেমন দরকার হলে মদের ব্যবস্থাও করতে পারে।
কান্তর ঘাড় থেকে যেন বোঝাটা নামল।
সেপাই দুজনও ঘাড়ের বন্দুক নামিয়ে গায়ের মুখের ঘাম মুছে নিলে। অনেক দূর পথ হেঁটে এসেছে। তাদের খিদে পাবার কথা। গাছতলাটায় বসল গিয়ে দু’জন।
ও কান্তবাবু! কান্তবাবু—
কান্ত কোতোয়ালের সঙ্গে দেখা করে খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্তের কথা বলতে যাচ্ছিল। হাতিয়াগড়ের রানি হিন্দুবিবি, মুসলমানের হাতের রান্না কেমন করে খাবে! তা ছাড়া, এখানে কতদিন থাকতে হবে, এখান থেকে মুর্শিদাবাদ যাবার আবার কী বন্দোবস্ত করা হয়েছে, তাও জানা দরকার। নবাব সরকারের চাকরির অনেক ল্যাটা। কোথাও কেউ মুখ খুলে কথা বলবে না। সবাই যেন সবাইকে সন্দেহ করে। অথচ যখন ফিরিঙ্গি কোম্পানিতে চাকরি করত তখন এসব ছিল না। বেভারিজ সাহেব তোক ভাল। কান্তকে বাবু বলে ডাকত। তিন টাকা করে মাইনে দিত সাহেব, কিন্তু মাইনেটা কম হলে কী হবে, সাহেব সেটা পুষিয়ে দিত নানাভাবে। সোরা বেচে বেশি লাভ হলে সেবার বকশিশ দিত। তা বকশিশ না দিলেও চাকরি না করে উপায় ছিল না কান্তর। বেভারিজ সাহেব চাকরি না দিলে কোথায় থাকত সে? বাঁচত কী করে? খেত কী? বড়চাতরা থেকে সেই যে সেবার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল, তারপরে কি আর সেখানে গিয়ে ওঠা যেত। গাঁ-কে-গাঁ যেন আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
সে এক ভয়ংকর কাণ্ড!
সেইবারই বেশি করে কাণ্ডটা হল।
ওই রাতদুপুরে আবার একদিন হইহই রইরই চিৎকার উঠল। বড়চাতরার তাবৎ লোক ঘুম ভেঙে যে-যেদিকে পারল ছুটল। কিন্তু সেবার বোধহয় একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। নাজিরদের বাড়িটার ওপর তখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে বর্গিরা। নাজিররাই বড়চাতরার বর্ধিষ্ণু লোক। বাড়িতে চিরকাল ধান, চাল, গুড়, নুন মজুত করা থাকে। তা সবাইকার জানা। তাই সেবার আর নাজিররা রেহাই পেতো না। দু-একটা গাদা বন্দুক বোধহয় ছুঁড়েছিল নাজিরবাবুর দিশি সেপাই। কিন্তু সে আর কতটুকু। কান্তরা যখন ঘুম ভেঙে উঠেছে তখন নাজিরদের বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে।