দিদিমাও কাঁদত। বলত–ওই হারামজাদারা তোর বাবাকেও খুন করে ফেলেছিল রে।
ওই সময়েই কী একটা হাঙ্গামায় মা গেল। রইল শুধু দিদিমা আর সে। দিদিমা বুড়ি মানুষ। কতদিন আর বাঁচবে! তবু যেক’দিন বেঁচে ছিল, ততদিন নাতির জন্যে অনেক করে গেছে। নাজিরদের চণ্ডীমণ্ডপে বরদা পণ্ডিতের পাঠশালা ছিল একদিকে, আর একদিকে ছিল সারদা পণ্ডিতের মক্তব। সারদা পণ্ডিত নিজে পড়াতেন না ছাত্রদের, মৌলবি রেখেছিলেন। মৌলবি ফারসি পড়াত পড়ুয়াদের।
নাজিরবাবু বলেছিলেন–কনেবউ, তুমি আবার নাতিকে ফারসি পড়াতে গেলে কেন বলল তো? সংস্কৃত পড়লে কি বিদ্যে হয় না?
দিদিমা বলেছিল–না কর্তাবাবু, তা নয়, নাতি চিরকাল চাষাভুষো হয়ে থাকবে, তা কি ভাল?
তা ফারসি শিখে তোমার নাতি নবাব সরকারে নায়েব-নাজিম হবে নাকি?
দিদিমা বলেছিল–নায়েব-নাজিম না হোক, নায়েব-নাজিমের খেদমদগার তো হতে পারবে? ফারসিটা শিখলে তবু সরকারি চাকরি অন্তত একটা তো পাবে।
তা নবাব-সরকারের চাকরিতে আর সে-গুড় ছিল না তখন। নবাব আলিবর্দি খাঁ নিজেই নবাব-সরকারের চাকরিতে ঢুকেছিল বলে নবাব হতে পেরেছিল মুর্শিদাবাদের। ওই মহারাজ রাজবল্লভ, পেশকার হয়ে ঢুকে মহারাজ। ওই রামনারায়ণ, জানকীরামের কাছে সরকারি চাকরি করেছিল বলেই পাটনার দেওয়ানি পেয়ে গিয়েছিল।
দিদিমার আশা ছিল অনেক। আশা ছিল নিজের জামাই তার যে-আশা মেটাতে পারেনি, বাপ-মা মরা নাতি তাই পারবে। কিন্তু দিদিমা যদি জানত যে শেষকালে তারই নাতি কিনা চাকরি নেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দপ্তরে!
কিন্তু সে-কথা এখন থাক!
কাটোয়ার কাছে আসতেই পালকি-বেহারারা থেমে গেছে। সেই সক্কালবেলা খেয়া পার হয়ে বেহারারা ছুটতে শুরু করেছে দুটো চিড়ে-মুড়কি মুখে দিয়ে। তারপর আর বিরাম নেই।
নিজামত-সরকারের তলব পেয়ে কাটোয়ার কোতোয়াল সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল। পালকিটা পোঁছোতেই ফৌজি সেপাই দুটো সামনে এসে খাড়া হল।
কান্তও তৈরি ছিল। পাশেই পাকাবাড়িটা। কোতোয়ালের লোক সামনেই হাজির ছিল। কান্ত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ঘর সাফ হয়েছে?
কোতোয়ালের লোক কান্তকে সেলাম করে বললে–হ্যাঁ হুজুর—
রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা?
সব তৈরি হচ্ছে হুজুর। বারোজনের রান্নার হুকুম দিয়েছেন কোতোয়াল।
রান্না করছে কারা? হিন্দু না মুসলমান?
হুজুর, মুসলমান!
কান্ত একটু অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে–কেন? মুসলমান কেন? হাতিয়াগড়ের রানি তো হিন্দু বিবি, মুসলমানের হাতের রান্না খাবেন কেন? হিন্দু রসুইয়ের বন্দোবস্ত হয়নি?
তা জানিনে হুজুর।
কান্ত বললে–ঠিক আছে, বিকে ডেকে দাও, রানিবিবিকে নিয়ে ভেতরে যাক, তারপরে আমি কোতোয়াল সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি–
ঝি নয়, বোরখা পরা বাঁদি বেরিয়ে এল রানিবিবিকে নামিয়ে নিয়ে যেতে। পালকির দরজা ফাঁক হতেই কান্ত দেখলে সলমাচুমকির ওড়না দিয়ে রানিবিবি মাথায় একটা ঘোমটা দিয়েছিল। পালকি থেকে মাথা নিচু করে বেরোতে গিয়েই ঘোমটাটা খসে গেল মুখ থেকে। আর কান্ত এক পলকে দেখে ফেললে রানিবিবির মুখখানা। দুপুরের রোদে মুখখানা লাল হয়ে গেছে। ফরসা রঙের ওপর লালচে আভা বেরোচ্ছে সারা মুখখানাতে। আর কপালের ঠিক মধ্যিখানে সিঁথির ওপর জ্বলজ্বল করছে মেটে সিঁদুর।
ফৌজি সেপাই দুটো সেইদিকে চেয়ে দেখছিল। পালকি-বেহারারাও দেখছিল। সেই তাদের দিকে নজর পড়তেই কান্ত নিজেই যেন কেমন অপরাধী মনে করলে নিজেকে। তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মুখখানা খানিকক্ষণের জন্যে অন্তত ভোলবার চেষ্টা করলে।
*
সারা পুঁথিখানায় এমনি সব বর্ণনা। ধুলো আর নোনা হাওয়া আর পোকার হাত থেকে পুঁথিখানাকে রক্ষে করা যায়নি। বাংলাদেশের জল-হাওয়াতে মানুষই বলে তাড়াতাড়ি মরে যায়, তায় আবার তুলোট কাগজ।
তুমি আমি এবং আর পাঁচজন যখন দু’শো বছর ধরে ইংরেজ রাজত্বে বাস করে সেকালের সব ইতিহাস ভুলে বসে আছি, তখন এমন একখানা পুঁথি কোথায় মাটির তলায় আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে ছিল তার হিসেব রাখবার প্রয়োজন বোধ করিনি! একদিন মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় চলে এসেছিল, তারপর কলকাতা থেকে দিল্লি। এই দু’শো বছরে শুধু যে যুগই বদলেছে তাই নয়, মানুষ বদলেছে, মানুষের মতিগতিও বদলেছে। আর মানুষই বা কেন, ভূগোলও বদলে গেছে। এখন যে-গঙ্গা হিমালয় থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত এসে এখানে পদ্মা নাম নিয়েছে, আসলে তা পদ্মাই নয়। আসলে তা ছিল সমুদ্র। সমুদ্র থেকে একদিন দ্বীপ জেগে উঠেছে, নতুন জনপদ যেমন সৃষ্টি করেছে, নতুন নদীও তাতে সৃষ্টি হয়েছে। রামায়ণের যে-গঙ্গা সাতটা ধারায় বয়ে গিয়েছিল, তার তিনটে স্রোত পুব দিকে গিয়ে নাম নিয়েছিল হ্লাদিনী, পাবনী আর নলিনী। আর পশ্চিম দিকে যে-তিনটে ধারা বয়ে গিয়েছিল, তার নাম সুচক্ষু, সীতা আর সিন্ধু। বাকি স্রোতটা মাঝখান দিয়ে ভগীরথের পেছন-পেছন সমুদ্রে গিয়ে পড়েছিল। এই স্রোতটার নামই গঙ্গা। ইংরেজরা যখন এল তখন গঙ্গার নাম বদলে তার নাম রাখলে কাশিমবাজার নদী। কাশিমবাজার পর্যন্ত কাশিমবাজার নদী, যেখানে ভাগীরথী জলাঙ্গীর সঙ্গে এসে মিশেছে। বাকিটা হল হুগলি নদী। আর এখন তো সবটাই হুগলি নদী।
এই হুগলি নদীরই কি কম নাম-ডাক! এই নদীটা দিয়েই একদিন নবাবের সেপাইয়া বর্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গেছে। এই নদীটা দিয়েই একদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সোরার নৌকো জাহাজ বোঝাই করে বিলেতে মাল পাঠিয়ে দিয়েছে। এই নদীটা দিয়েই একদিন হাতিয়াগড়ের জমিদার মুর্শিদাবাদের সরকারে খাজনা জমা দিতে এসেছে। এই গঙ্গার পাড়ের ওপরেই কিরীটেশ্বরীর মন্দির। মুর্শিদকুলি খাঁ’র কানুনগো দর্পনারায়ণ এই কিরীটেশ্বরীর মন্দির নতুন করে গড়ে দিয়ে নিজের দেবভক্তি প্রচার করেছিলেন। ঢাকা থেকে ফিরে যতদিন ডাহাপাড়ায় বাস করেছিলেন ততদিন এই মন্দিরের তত্ত্বাবধানের দিকে লক্ষ রেখেছিলেন। এইখানেই আছে রাঙামাটি। এখানকার মাটি লাল। হিউ-এন-সাং তার ভ্রমণবৃত্তান্তে যাকে বলেছেন কর্ণসুবর্ণ, এই রাঙামাটিই সেই কর্ণসুবর্ণ। মহারাজ দাতাকর্ণের অন্নপ্রাশনের সময় বিভীষণ এখানে স্বর্ণবৃষ্টি করেছিলেন, তাই নাকি এর নাম হয়েছিল কর্ণসুবর্ণ। কে জানে! কত রকম গল্প জড়িয়ে আছে এই দেশকে ঘিরে, সব লিখতে গেলে এ-বইও মোটা হয়ে যাবে, তখন আপনারাও বিরক্ত হয়ে যাবেন, আমারও স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে রাত জেগে লিখে লিখে।